Wellcome to National Portal
মেনু নির্বাচন করুন
Main Comtent Skiped

প্রখ্যাত ব্যক্তিত্ব

আলহাজ্ব মোহাম্মদ তৈমুরঃ

দিনাজপুরের একজন সর্বজন শ্রদ্ধেয় কৃতি সন্তান, প্রাথমিক যুগের অগ্রণী শিক্ষাবিদ ও শিক্ষা বিভাগীয় উচ্চ কর্মকর্তা আলহাজ্ব মোহাম্মদ তৈমুর দিনাজপুর শহরের বাহাদুর বাজার মহল্লার অধিবাসী ছিলেন। উক্ত মহল্লায় তার প্রাচীন ধরনের বাসভবন এখনও অবস্থিত।ব্যক্তিগত জীবনে ছিলেন বুজর্গ ধার্মিক, ন্যায়পরায়ন, সরল ও অমায়িক ব্যক্তিত্বের অধিকারী অত্যন্ত জ্ঞান পিপাসু ও ইসলামী সাহিত্য চর্চার নিবেদিত গবেষক। কোরআন প্রবেশিকা ‘তারা জানেনা ইসলাম কি’ মুসলমানের তেত্রিশ কোটি দেবতা’ প্রভৃতি মূল্যবান গ্রন্থেও লেখক রূপে তিনি একজন যশস্বী ব্যক্তিত্ব।

 যে কালে শিক্ষার ব্যাপারে দিনাজপুরে ছিল ‘আইয়্যামে জাহেলিয়াত’ এর যুগ, তখন তিনি শিক্ষা প্রচারে অগ্রণী ছিলেন। চাকুরী জীবনে তিনি মক্তব মাদ্রাসা ও স্কুল প্রতিষ্ঠা কল্পে গ্রামের জনসাধারণকে উৎসাহিত করেন এবং প্রতিষ্ঠিত স্কুলগুলির মঞ্জুরীদানের ব্যবস্থা করে দেন। সেই যুগেও তিনি নারী শিক্ষায় অগ্রণী ছিলেন। তার ছেলে ও মেয়েরা সবাই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চ শিক্ষিত এবং চাকুরী ক্ষেত্রে উচ্চতর আসনের অধিষ্ঠিত। শেষ বয়সে তিনি চিকিৎসার জন্য কলিকাতায় যান এবং তথায় মৃত্যুবরণ করে। তিনি ১৯৪৬ খ্রীষ্টাব্দে মৃত্যু বরণ করেন।


এম আব্দুর রহিম 

এম আব্দুর রহিম (২১ নভেম্বর ১৯২৭ - ৪ সেপ্টেম্বর ২০১৬) একজন বাংলাদেশী রাজনীতিবিদ ছিলেন। তিনি বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ন কমিটির অন্যতম সদস্য ছিলেন। তিনি ১৯৭০ সালে দিনাজপুর সদর ও চিরিরবন্দর (আংশিক) থেকে প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ অবদানের জন্য ২০১৮ সালে তিনি স্বাধীনতা পদক পান। আব্দুর রহিমের জন্ম ১৯২৭ সালের ২১ নভেম্বর দিনাজপুর জেলায় । মাদ্রাসা শিক্ষায় শুরু হয় তার প্রথম পাঠ। ১৯৪২ সালে জুনিয়র পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে রাজশাহী হাই মাদ্রাসা (বর্তমান : হাজী মুহম্মদ মুহসীন সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়) হতে মেট্রিকুলেশন পাশ করেন। ১৯৫০ সালে ১ম বর্ষে ভর্তি হন রাজশাহী কলেজে। সেখান থেকে ভর্তি হন কারমাইকেল কলেজে। সেখান থেকে উচ্চ মাধ্যমিক সম্পন্ন করার পর ১৯৫৬ সালে রাজশাহী কলেজ থেকে বি এ পাশ করে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে ভর্তি হন। ১৯৫৯ সালে এল এল বি ডিগ্রি অর্জন করেন তিনি। ১৯৬০ সালে আইনজীবী হিসেবে দিনাজপুর বারে আইন পেশা শুরু করেন। ছাত্র থাকা অবস্থায় পাকিস্তান বিরোধী স্বাধিকার আন্দোলনে যোগ দেন। রাজশাহী কলেজের ছাত্র থাকা অবস্থায় ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনের সকল কর্মসূচিতে অংশ নেন। কলেজের শহীদ মিনার নির্মাণে তিনি অগ্রণী ভূমিকা রাখেন। ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে তিনি হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সাথে নির্বাচনী কাজ করেন।

আব্দুর রহিম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সহ অন্যান্য নেতার বিরুদ্ধে দায়ের করা ঐতিহাসিক আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার লিগ্যাল এইড কমিটির সদস্য ছিলেন। তিনি ১৯৭০ সালে দিনাজপুর সদর ও চিরিরবন্দর (আংশিক) থেকে প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। পরবর্তীতে ১৯৯০ সালে তিনি জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। স্বাধীনত বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ন কমিটির অন্যতম সদস্য ছিলেন। স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি হন তিনি। তিনি দিনাজপুর জেলা আওয়ামী লীগ কমিটির সভাপতি, জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য এবং উপদেষ্টামন্ডলীর সদস্য হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। আব্দুর রহিম দুই ছেলে ও চার মেয়ের পিতা। বড় ছেলে হলেন বিচারপতি এম এনায়েতুর রহিম এবং ছোট ছেলে হলেন সংসদ সদস্য ইকবালুর রহিম। আব্দুর রহিম ২০১৬ সালের ৪ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশের ঢাকার বার্ডেমে মৃত্যুবরণ করেন। ২০১৮ সালে স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার তাকে মরণোত্তর স্বাধীনতা পদক প্রদান করে।


স্বভাব কবি মোঃ নূরুল আমিন

মোঃ নূরুল আমিন। একজন স্বভাব কবি। দিনাজপুরের সাহিত্য ও সাংবাদিকতায় অন্যতম প্রথিকৃৎ। এই কবি আজ মহা নিদ্রায় শায়িত। তিনি জন্মেছিলেন ১৯১৪ সালের ১২ ফেব্রুয়ারী গোপালগঞ্জ জেলার কাশিয়ানী থানাধীন ঘোনাপাড়া গ্রামে এক বনেদী সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে। পিতা অলিমুদ্দীন সরদার এবং মাতা মোওলাতুন্নেছা পরিবিবি। স্কুল জীবন হতে তাঁর কাব্যচর্চা শুরু হয়। তিনি ১৯৩১ সালে গুরু ট্রেনিং পরীক্ষায় কৃতিত্বের সাথে কলকাতা শিক্ষা বোর্ডের মেধা তালিকায় ১৭তম স্থান অধিকার করেন। কিন্তু গুরুগিরি তাঁকে ধরে রাখতে পারেনি। বেরিয়ে পড়েন দেশ ভ্রমনে। ১৯৪৫ সালে দিনাজপুর এসে পৌঁছেন এবং সবুজ শ্যামলিমার কারুকাজ খচিত দিনাজপুরের প্রেমে পড়ে যান প্রথম দর্শনেই। স্থায়ী নিবাস গড়ে তোলেন দিনাজপুরের পাহাড়পুরে।

কবি মোঃ নূরুল আমিন ছিলেন সহজাত কবি এবং সাংবাদিক। সাহিত্য এবং সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে দিনাজপুরের তখন শৈশবকাল। সবেমাত্র হাঁটি হাঁটি পা পা করছে সাহিত্যের আড্ডাখানা। সুনির্দিষ্ট কোন ঠিকানায় নয়, কবি মোঃ নূরুল আমিনসহ সমমনা কয়েকজন বসতেন মুন্সিপাড়া দবিরের চায়ের দোকানে, গাছের তলায় ঘাসের কার্পেটে বা কোন কবি-সাহিত্যিকের আসরে। চলত কবিদের স্বরচিত কবিতা পাঠের আসর কিংবা প্রবন্ধ পাঠ। এই আড্ডাখানায় যারা আড্ডা দিতেন তাদের মধ্যে ছিলেন কবি কাজি কাদের নেওয়াজ, বিশিষ্ট সমাজসেবী মঈনুদ্দিন আহম্মেদ চৌধুরী, কবি মোঃ নূরুল আমিন, খাজা নাজিমুদ্দিন হল লাইব্রেরীর প্রতিষ্ঠাতা আলহাজ্ব হেমায়েত আলী, কবি সোলেমান আলী, অধ্যাপক সোলেমান, ঐতিহাসিক মেহেরাব আলী, কবি আ.ক.শ নূর মোহাম্মদ, কবি ফুলুমদ্দীন মন্ডল, ডা. মাহাতাব উদ্দীন আহম্মেদ, কবি রসরাজ আহমাদ হোসেন, সুফী কবি আব্দুল জববার প্রমুখ। আড্ডাখানা বসত কোন নির্দিষ্ট সময় ধরে নয়। সাধারণতঃ বিকেলে বা সন্ধ্যায়।

কবি মোঃ নূরুল আমিন এবং তার সমমনা বন্ধুদের সাহিত্য আড্ডাকে ঘিরে একদিন পদযাত্রা শুরু হয়েছিল কবি-সাহিত্যিকদের। সেই শোভাযাত্রায় আজ অনেক প্রতিভাধর কবি সাহিত্যিক গড়ার অন্যতম কারিগর ছিলেন কবি মোঃ নূরুল আমিন। দেশ স্বাধীন হবার পরও দিনাজপুরের সাহিত্য চর্চার এই মানুষটি সাহিত্যিক গঠনের কর্মী হিসেবে অবিস্মরণীয় ভূমিকা পালন করে গেছেন। দেশ স্বাধীন হবার পর তিনি গঠন করেন ‘‘নওয়াজ সাহিত্য মজলিশ’’। তরুণ কবি-সাহিত্যিকদের তিনি আমৃত্যু উৎসাহ যুগিয়ে গেছেন লিখতে, সৃষ্টি সুখের উল্লাসে মেতে উঠতে। তার রচিত গ্রন্থগুলোর মধ্যে দিনাজপুর দর্পন কাব্য, নবী কাহিনী, সৃষ্টির বিচিত্র লীলা, গুঞ্চায়ে উম্মিদ, নতুন ছড়া, ছেলেমেয়েদের প্রথম পাঠ উল্লেখযোগ্য। এছাড়া প্রায় ৩০০ শতাধিক পান্ডুলিপি মুক্তিযুদ্ধের সময় পাক হানাদার বাহিনী পুড়ে দেয়।

 

কবি মোঃ নূরুল আমিন শুধু দিনাজপুরের সাহিত্য চর্চার ক্ষেত্রেই পথিকৃৎ ছিলেন না, সাংবাদিকতা চর্চার ক্ষেত্রেও তিনি পালন করে গেছেন অগ্রণী ভূমিকা। ১৯৫৮ সাল হতে তিনি দৈনিক ইত্তেফাকের দিনাজপুর সংবাদদাতা হিসেবে কাজ শুরু করেন। এ সময়ে দিনাজপুরে সাংবাদিকতার সাথে জড়িত ছিলেন গুটি কয়েক ব্যক্তি। এঁরা হলেন অধ্যাপক ইউসুফ আলী, অধ্যক্ষ মোকাররম হোসেন, তাজমিলুর রহমান, আনোয়ারা রহমান, মাসুমা খাতুন, কবি মোঃ নূরুল আমিন, নেহাল আক্তার, মেহেরাব আলী, এ হেমায়েত আলী, আব্দুল বাড়ী ও বশির উদ্দিন প্রমুখ। দিনাজপুরে সাংবাদিকতার বীজ বপনকাল হিসেবে এই সময়টাকেই ধরা হয়। ১৯৬৫ সালে দিনাজপুর প্রথম গঠন করা হয় প্রেসক্লাব। সেই প্রেসক্লাবের সভাপতি নির্বাচিত হন কবি মোঃ নূরুল আমিন। তবে তৎকালীন জেলা প্রশাসক আব্দুর রউফ চৌধুরীর মতে কোন আওয়ামী লীগের সদস্য প্রেসক্লাবের সভাপতি হলে গভর্নর মোনেম খান সেই প্রেসক্লাবের উদ্বোধন করবেন না। তবে মুসলিম লীগের কোন সদস্যকে সভাপতি করলে গভর্নর সে অনুষ্ঠানে আসবেন। সে কারণেই কবি মোঃ নূরুল আমিন স্বেচ্ছায় সভাপতির পদ থেকে সরে দাঁড়ান এবং তৎকালীন সদর মহকুমা মুসলিম লীগের সম্পাদক তাহের উদ্দিন আহম্মেদকে সভাপতি করা হয়। উদ্বোধনের কিছু দিন পরেই কবি মোঃ নূরুল আমিনকে দিনাজপুর প্রেসক্লাবের আবারো সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। কবি মোঃ নূরুল আমিন দীর্ঘ একযুগ (১৯৬০-১৯৬৪) প্রেসক্লাবের সাথে জড়িত থেকে কার্যকর নেতৃত্ব দিয়েছেন সাংবাদিকদের। দিনাজপুরে সাংবাদিকতা বিকাশের ব্যাপারে তাঁর ভূমিকা চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।

দিনাজপুরে সাহিত্য ও সাংবাদিকতার আকাশে উজ্জ্বল নক্ষত্র কবি মোঃ নূরুল আমিন ২০০০ সালের ২২শে নভেম্বর সকাল ৮.৩০ মিনিটে ইন্তেকাল করেন। দিনাজপুরের আপামর জনসাধারণ তাঁকে চিরদিন গভীর শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে।


পন্ডিত মহেশচন্দ্র তর্কচুড়ামনিঃ

 

ভারত বিখ্যাত সংস্কৃত পন্ডিত ছিলেন এবং ছিলেন দিনাজপুর রাজপুরোহিত ও সভাপন্ডিত। বহু সংস্কৃত কাব্যের লেখক পন্ডিত মহাশয়ের খ্যাতিপূর্ণ গ্রন্থ ছিল ‘রাজবংশনম’’। এছাড়া আরো একখানা জ্ঞাগর্ভ সংস্কৃত কাব্যের লেখক ছিলেন তিনি। অধ্যাপক প্রিয়বন্ধন সেন, পি.আর.এম রচিত western influence on Bengali literature.নামক বিখ্যাত গ্রন্থে তদীয় প্রজ্ঞা ও আকরিব জ্ঞান গরিমার আলোচনা স্থান পেয়েছে। তারা জন্ম হয় ১৮৪১ সালে এবং মৃত্যুবরণ করেন ১৯২৭ সালে পরিণত বয়সে। শহরের পূর্ব উপকন্ঠে রাজারামপুর গ্রামে তার বাসভূমি ছিল।

 

ক্ষেত্রমোহন ভট্টাচার্য্য (১৯০৬-১৯৮২):

 

          ঐতিহ্যবাহী দিনাজপুর শহরের খ্যাতনামা সংগীত সাধক ও শিক্ষক প্রয়াত ক্ষেত্রমোহন ভট্টাচার্য্য  ১৯০৬ সালের ০৬ নভেম্বর  দিনাজপুর জেলাধীন নবাবগঞ্জ  থানার নির্শা কাজলদিঘী  গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত  ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা ছিলেন নবাবগঞ্জের  সম্ভ্রান্ত জমিদার আশুতোষ ভট্টাচার্য্য। তাঁর শৈশব, কৈশোর ও যৌবন কেটেছে মধ্য বালুবাড়ী পল্লীশ্রী সংলগ্ন দিনাজপুর শহরে অবস্থিত তাঁর পৈত্রিক নিবাসে। আজও সেই বিশাল আয়তনের বাড়ীটি  জরাজীর্ন অবস্থায় তাঁর স্মৃতি বহণ করে চলেছে। পরবর্তীতে জীবনের অন্তিম মুহুর্তে তিনি দিনাজপুর শহরের নিমনগর মহিলা কলেজ (সাবেক সুরেন্দ্রনাথ কলেজ) মোড়ে  আবাসন গ্রহণ করেন। তাঁর জীবনকালের সমস্তটা  জুড়েই একজন সংগীত  শিক্ষক, শিল্পী এবং সর্বোপরী  একজন সংগীত সাধক  হিসেবে  আত্মনিয়োগ করেন। তাঁর সুর করা বিভিন্ন গানের রেকর্ড সারা বাংলায় অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিল।  তিনি ছিলেন কলকাতা বেতারের নিয়মিত শিল্পী। ব্যক্তিগত  ও পারিবারিক কারনে তিনি চিরকুমার ছিলেন। ২২শে জুন ১৯৮২ সালে তিনি পরলোকগমন করেন। তাঁর ছাত্র-শিষ্যরা স্বনামে দিনাজপুর, ঢাকা, কলকাতা সহ সারা বাংলাদেশ ও  পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে আছেন।

          ক্ষেত্রমোহন ভট্টাচার্য্য পাঠাগারের উদ্যোগে প্রতি বছর তাঁর  জন্মদিন ও মৃত্যুবার্ষিকীতে স্মরণসভা,  গুণীজন সংবর্ধনা  ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়ে থাকে।

 

 

জেহের উদ্দিন মোক্তারঃ

 

মুন্সীপাড়া নিবাসী। দিনাজপুর বারে লদ্ধ প্রতিষ্ঠিত আইনজীবি, প্রভাবশালী মুসলমান সমাজপতি, সেকালে উদযাপিত মহরম উৎসবের প্রধান পৃষ্ঠাপোষক এবং সমকালীন রাজনৈতিক ধারার সঙ্গে সস্পৃক্ত শহরের বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব ছিলেন। জনসেবার কাজে বহুবার তার নাম মাসিক দিনাজপুর পত্রিকায় উল্লেখ পাওয়া যায়। তিনি বিংশ শতকের প্রথম দশকে মৃত্যু বরণ করেন।

 

 

পীর শাহ সুফি মতলুব মিয়াঃ

 

পেশা জীবনে ছিলেন পুলিশ অফিসার কিন্তু ব্যক্তি জীবনে ছিলেন সুফিতত্ব সাধনায় অসাধারণ বুজর্গ পীর মোকাম্মেল ও ইসলাম প্রচারক। হজরত খাজা বাবার খাদেমকহলের একজন। শাহ মতলুব মিয়ার অগনিত মুরিদান ও আশেকান ছিল দেশের সর্বত্র। তিনি অলৌকিক কেরামতধারী ছিলেন এবং একালেও যে সব কেরামতির অসংখ্য গল্প কাহিনী ছড়িয়ে আছে লোক পরম্পরায় যা প্রামাণ্য সত্যের মতোই বিশ্বাসযোগ্য।

 

 

নাট্যশিল্পী ও নাট্যকার শ্রী শিবপ্রসাদ করঃ

 

স্বনামধন্য নাট্যাভিনেতা, নাট্যকার, মঞ্চাধ্যক্ষ নাট্য সংগঠক ও ক্রীড়াপরিচালক শিব প্রসাদ কর ছিলেন গণেশতলা মোড়ের কর বংশীয় জমিদার পরিবারের কৃতি সন্তান। দিনাজপুর নাট্য সমিতি ছিল তার নাট্যচর্চা ক্ষেত্র। এক পর্যায়ে মাসিক দিনাজপুর পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন (১৯৪২-৪৫)। দে শ বিভাগের পর বালুরঘাটে উদ্বাস্ত্ত হন। তিনি ১৯৬৪ খ্রীষ্টাব্দে মৃত্যু বরণ করেন।

 

 

খাঁন বাহাদুর মাহতাব উদ্দিন আহমদঃ

 

জেলার প্রথম দিকের মুসলমান শিক্ষাবিদ, বিভাগীয় স্কুল ইন্সপেক্টর মাহতাবউদ্দিন আহমদ যে কালে সরকারী উচ্চ পদে চাকুরীজীবি তখন ঐসব পদে মুসলমানের সংখ্যা সামান্যই ছিল। তাই তিনি মুসলমান সমাজের গর্বের পাত্র ছিলেন। সমানই গৌরবের কারণ ছিলেন খাঁনবাহাদুর উপাধি পাওয়ায়। চাকুরী থেকে অবসর হয়ে জেলার রাজনীতিতে যোগদান করেন এবং প্রথম পদক্ষেপেই জেলাবোর্ডের চেয়ারম্যান হন। পরবর্তীতে ১৯৩৭ সালের নির্বাচনে তৎকালীন জনপ্রিয় নেতা বিশিষ্ট আইনজীবী মির্জা কাদের বক্সকে পরাজিত করে প্রাদেশিক আইন সভার সদস্য হন । সৎ, সদালাপী ও পরোপকারী এই মানুষটি জনগণের এতই মন জয় করতে পেরেছিলেন যে, তখন তার নামটি ছিল সবার মুখে মুখে। দিনাজপুর শহরের কসবায় তার বাস ভবন ছিল। তিনি ১৯৪১ খ্রীষ্টাব্দে মৃত্যু বরণ করেন।

 

 

শ্রী মাধব চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ঃ

 

দিনাজপুর জেলা শাখা কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি (১৮৯০ সালে স্থাপিত) ও দিনাজপুর বারের আইনজীবি শ্রীমাধব চন্দ্র  দিনাজপুর শহরের বড়বন্দর মহল্লার অধিবাসী ছিলেন। তার বড়বন্দর বাসায় আহুত জনসভায় ১৮৯০ সালে ইংলান্ড দেশাগত প্রসিদ্ধ ব্যারিষ্টার মিং মর্গানোর উপস্থিতিতে জেলা কংগ্রেস শাখা গঠিত হয়। বারের প্রাথমিক যুগের ইংরেজী নবিশ উকিলদের মধ্যে তিনি ছিলেন অন্যতম শ্রেষ্ঠ। প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা ও সমাজ সেবক রূপে তার প্রচুর সুনাম ছিল। তিনি এক পর্যায়ে বারের সভাপতি ছিলেন। তিনি ১৯১২ খ্রীষ্টাব্দে মৃত্যু বরণ করেন।

 

 

মাওলানা আয়েন উদ্দিন আহমদঃ

বিগত শতকের দিকে বিশ ত্রিশ দশকে তিনি লালবাগ আরবী মাদ্রাসার দীর্ঘকালীন শিক্ষক ছিলেন। কলিকাতা নিবাসী মওলানা আয়ন উদ্দিন আরবী সাহিত্যে এবং বিশেষ করে কোরআন, হাদিস, ফেকা প্রভৃতি শাস্ত্রে অসাধারণ আলেম ছিলেন। ইসলাম প্রচারেও তার সবিশেষ সুখ্যাতি ছিল।

 

 

ডাঃ সুকুমার সেন গুপ্তঃ

 

বৃটিশ আমলে দিনাজপুর থেকে প্রথম ব্যাচে যে ডাক্তারগণ এম বি পাশ করেন তাদের একজন কৃতি ডাক্তার ছিলেন সুকুমার সেন গুপ্ত। যখন জেলায় কোন বিশেষ রোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকই ছিল না তখন ডাঃ সুকুমার ছিলেন একজন কালাজ্বর বিশেষজ্ঞ। ঐ সময় দিনাজপুরে কালাজ্বরের প্রচন্ড ব্যাপকতা ছিল। এই রোগ চিকিৎসায় তিনি প্রচুর খ্যাতি অর্জন করেন। দিনাজপুর শহরের ঘাসিপাড়ায় তার বাসভবন ছিল।

 

তিনি অত্যন্ত গোলাপ ফুলের চাষবিলাসী ছিলেন এবং বাড়ীর উঠানে উন্নত জাতের ফুল চাষ করতেন। ৪৭ এর পর উদ্বাস্ত্ত হয়ে বালুরঘাটে উপনিবিষ্ট হন। তিনি ১৯৮১ খ্রীষ্টাব্দে মৃত্যু বরণ করেন।

 

 

অধ্যাপক আব্দুল বাকীঃ

দিনাজপুরবাসী (বৃহত্তর) মুসলিম সমাজের প্রথম যুগের উচ্চ ডিগ্রীধারী শিক্ষাবিদ রূপে অধ্যাপক আব্দুল বাকী ছিলেন দিনাজপুরের গৌরব। যে কালে মুসলমান সমাজে সামান্য লেখাপড়ার প্রচলন প্রায় অনুপস্থিত ছিল সেই অন্ধকার যুগে অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র আব্দুল বাকী কলিকাতা আলীয়া মাদ্রাসা পাশ করে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আরবী ভাষা-সাহিত্যে ১ম শ্রেণীতে ১ম স্থান অধিকার তথা রেকর্ড ভঙ্গকারী নম্বর পেয়ে এম এ পাশ করেন; তদুপরি অসাধারণ কৃতিত্বের পুরস্কার স্বরূপ স্বর্ণ পদক লাভ করেন (১৯৩২)। তিনি সরকারী কলেজে অধ্যাপনা করেন আমৃত্যু। কলেজের সাধারণ দায়িত্ব পালন করা ছাড়াও তিনি ছিলেন সার্বক্ষণিক গবেষক ও লেখক। আরবী, ফার্শি, ইংরেজী, বাংলা ও উর্দুতে ছিল গভীর পড়াশোনা ও পান্ডিত্ব। বাংলা ছাড়াও প্রবন্ধ লিখতেন ইংরেজীতে। কবি ইকবাল দর্শনে প্রভাবিত অধ্যাপক বাকী ইকবাল কাব্য নিয়েও গবেষণা করেন এবং তৎসংক্রান্ত বহু জ্ঞানগর্ভ নিবন্ধ প্রকাশিত হয় বহু পত্র-পত্রিকায়। লোকনন্দিত বক্তাও ছিলেন তিনি। তিনি এমন সরল সাবলীল মনোজ্ঞ ভঙ্গিতে বক্তব্য রাখতে পারতেন, যা শুনে শ্রোতারা আকর্ষিত না হয়ে পারত না। তার কোন গ্রন্থ প্রকাশিত হয়নি। পশ্চিম দিনাজপুর থেকে উদ্বাস্ত্ত হয়ে অত্র শহরের বালুয়াডাঙ্গায় অভিবাসিত হন। দুরারোগ্য ব্যধিতে আক্রান্ত হয়ে তিনি অকালে মৃত্যুবরণ করেন। তিনি ১৯৮১ খ্রীষ্টাব্দে মৃত্যু বরণ করেন।

 

 

শ্রী প্রেমহরি বর্মনঃ

দিনাজপুর থেকে প্রথম সম্মানীয় মন্ত্রীপদ প্রাপ্ত প্রেমহরি বর্মন ছিলেন জেলা তফশিলী সম্প্রদায়ের নেতা ও তফশিলী সমাজের প্রথম উচ্চ শিক্ষিত তথা ঐ সম্প্রদায় থেকে আসা বারের প্রথম আইনজীবীও। ১৯৩৭ সালে এমপি নির্বাচিত হন। ১৯৪২ সালে প্রাদেশিক আইন সভার মন্ত্রী পদ লাভ করেন। ১৯৪৬ এর গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনের সময় তফশিলী সম্প্রদায় মুসলিম লীগ দলের সঙ্গে সহযোগিতার সম্পর্ক স্থাপন করায় তিনি তফশিলী ফ্রন্টের টিকিটে এমপি নির্বাচিত হন। অতি সরল, বিনয়ী ও সৎ চরিত্রের মানুষ মিঃ বর্মন কালীতলা নিবাসী ছিলেন। তিনি ১৯৭২ খ্রীষ্টাব্দে মৃত্যু বরণ করেন।

 

 

জয়নব রহিমঃ

তিনি দিনাজপুরের প্রথম মুসলমান মহিলা গ্র্যাজুয়েট জয়নব রহিম ঘাসীপাড়া নিবাসী সাবরেজিস্ট্রার আব্দুর রহীমের কন্যা ও কসবার খাঁন বাহাদুর মাহতাবউদ্দিন আহমদের পুত্রবধূ ছিলেন। কৃতিত্বের সঙ্গে উচ্চ শিক্ষা লাভ করার পর জয়নব রহীম কলিকাতা কর্পোরেশনের পরিচালনাধীন স্কুল পরিদর্শিকা নিযুক্ত হন এবং তার আজীবন কর্মক্ষেত্র ছিল কলিকাতা। তদীয় স্বামী ডাঃ মোতাহার উদ্দিন আহমদও ছিলেন কলিকাতা কর্পোরেশনের মেডিক্যাল অফিসার। তিনি ১৯৮০ খ্রীষ্টাব্দে মৃত্যু বরণ করেন।

 

 

ডাক্তার সারদা কান্ত রায়ঃ

শহরের প্রাথমিক ডাক্তারগণের অন্যতম ছিলেন। এল,এম,এফ পাশ ডাক্তার হয়েও তিনি চিকিৎসা ব্যবসা করেন হোমিও পদ্ধতিতে। তখন শহরের সবেমাত্র হোমিও চিকিৎসা প্রবর্তন হয়। তিনি গভীর পড়াশোনা ও কঠোর সাধনায় উক্ত চিকিৎসা ব্যবস্থায় এমন প্রজ্ঞা পান্ডিত্য অর্জন করেন যে জেলার অদ্বিতীয় চিকিৎসকের মর্যাদা লাভ করেন। হোমিও চিকিৎসা বিষয়ে তিনি সুপন্ডিত এবং সুলেখকও ছিলেন।

 

 

ডাঃ হাজী মফিজউদ্দিন আহমদঃ

দিনাজপুরে মুসলমান ব্যবসায়ী হিসেবে প্রসিদ্ধ ঔষধ বিক্রেতা মফিজউদ্দিন আহমদ বহু অধ্যাবসায়ের বলে শহরে সুপ্রতিষ্ঠিত হন। তার প্রতিষ্ঠিত ঔষধ ব্যবসার নাম ছিল বেঙ্গল মেডিক্যাল স্টোরস। ঔষধ ব্যবসা বাদেও ছিল বিভিন্ন ঠিকাদারী ব্যবসা এবং সময়ের হাওয়া অনুকূল থাকায় (দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ কাল) তিনি প্রচুর অর্থ উপার্জন করতে সক্ষম হন। এমনকি অর্থবিত্তে শহরের একজন ধনাঢ্য ব্যক্তির পংক্তিতে উন্নীত হন। মুন্সীপাড়ায় একটি ছাপাখানা (বেঙ্গল প্রেস) প্রতিষ্ঠা করেন (১৯৩৫) যা ছিল শহরে মুসলমান প্রতিষ্ঠিত প্রথম প্রেস। তীক্ষ্ণ মেধা ও সূক্ষ দৃষ্টি সম্পন্ন ব্যস্ত ব্যবসায়ী হয়েও তার জ্ঞান পিপাসা ছিল অসাধারণ। হাদিস কোরআন বিষয়ক জ্ঞানের অনুসন্ধিৎসায় তিনি আরবী ভাষায় স্বশিক্ষিত আলেমের দরজা লাভ করেন। আরবী, উর্দু ও বাংলা ভাষায় প্রচুর গ্রন্থাদির সংগ্রহ সমৃদ্ধ তার একটি পারিবারিক লাইব্রেরী ছিল। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি অত্যন্ত পরিশ্রমী ও উচ্চাকাঙ্খী ছিলেন এবং ধার্মিক মুসলমান রূপে প্রচুর সুনাম অর্জন করেছিলেন। তিনি ১৯৮৬ খ্রীষ্টাব্দে মৃত্যু বরণ করেন।

 

 

কবি নূর মোহাম্মদঃ

১৯৪৭ এর দেশ বিভাগের পর প্রাথমিক যুগের বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ কবি নুর মোহাম্মদ। তিনি মূলতঃ কবি হয়েও গান, উপন্যাস, নাটক, জীবনী, প্রবন্ধ প্রভৃতি রচনাতেও সিদ্ধহস্ত ছিলেন। গৌড়বঙ্গ সাহিত্য পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা, নওরোজ সাহিত্য মজলিশের প্রতিষ্ঠাতাদের অন্যতম এবং অনেক কাব্য, উপন্যাস, ইতিহাস, জীবণী গ্রন্থের লেখক ছিলেন। তিনি ১৯২৩ খ্রীস্টাব্দ জন্মগ্রহন করেন এবং ১৯৮৪ খ্রীষ্টাব্দে মৃত্যু বরণ করেন।

 

 

মির্জা কাদের বকস্

মির্জাপুরের বিখ্যাত মির্জা পরিবারের কৃতিসন্তান কাদের বক্স জেলা বারের একজন লব্ধ প্রতিষ্ঠ আইনজীবি ছিলেন। মুসলিম লীগ জেলা শাখার প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি (১৯১৫-১৬), বঙ্গীয় আইন পরিষদের সদস্য (এমএলসি), জেলা বোর্ডের ভাইস চেয়ারম্যান প্রভৃতি বহু দায়িত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব ছাড়াও সমকালীন বহু সামাজিক সংস্থা, সংগঠন, বিশেষ করে শিক্ষা বিস্তারে একজন অক্লান্ত পরিশ্রমী ও উদ্যোক্তা ছিলেন। সাহসিকতা, নির্ভিক কন্ঠ ও স্পষ্টবাদীতা ছিল তার সহজাত চরিত্রগুণ। সেজন্য তাকে বলা হতো দিনাজপুরের সিংহ পুরুষ। তিনি যে কালের মানুষ তখন দেশে প্রবল সাম্প্রদায়িক বিভেদ-বিদ্বেষ ছিল। কিন্তু সমাজ মনের সেই দুরবস্থাটি তার কাছে ছিল অপ্রীতিকর ও অসহ্যকর। সাম্প্রদায়িকতার গন্ধ পেলেই তিনি প্রতিপক্ষকে ছুঁড়ে মারতেন রুঢ়তম উচিত কথা। স্বীয় সমাজের দাবী আদায়ের পটভূমিতেও তিরন ছিলেন আপোশহীন নেতা। এ নিয়ে প্রচলিত প্রচুর ঘটনাও গল্প কাহিনীর দর্পণে ভাস্বর হয়ে আছে তার সত্যিকারের পরিচয়। বালুবাড়ীতে স্বীয় বাসভবনের মসজিদটি (সাবেক মসজিদ) তারই আমলে নির্মিত হয়। তিনি ১৯৪৫ খ্রীষ্টাব্দে মৃত্যু বরণ করেন।

 

 

গোলাম রব্বানী আহমেদঃ

প্রথম দিকের জেলাবাসী মুসলমান উচ্চ শিক্ষিতদের অন্যতম বিশিষ্ট মেধাবী শিক্ষাবিদ গোলাম রব্বানী স্কুল পরিদর্শক ছিলেন। বিজ্ঞ ইংরেজী ভাষাবিদ বলে চাকুরী মহলে তার প্রচুর সুনাম ছিল। চাকুরী থেকে অবসরান্তে তিনি রাজনীতিতে যোগদান করেন। ১৯৪২ সালে সদর এলাকার উপ-নির্বাচনে প্রাদেশিক আইন পরিষদের সদস্য হন। স্বল্পকালীন রাজনৈতিক জীবনে জনসাধারণের জন্য বড় কিছু সুবিধা করতে পারার আগেই ১৯৪৬ এর গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচন আসে। তিনি রাজনীতি ছেড়ে দেন। দিনাজপুর সদর উপজেলার পাটুয়াপাড়ায় তার বাস ভবন ছিল। তিনি ১৯৬১ খ্রীষ্টাব্দে মৃত্যু বরণ করেন।

 

 

চারণ কবি আমিরুদ্দিন সরকারঃ 

কবি গানের সরকার রূপে জনপ্রিয় ছিলেন তদীয় জীবদ্দশায়। বিশেষ করে গণ মানুষের কবিয়াল ছিলেন। শতাধিক কবিতা পুস্তক রচনা করেন। তবে পুস্তিকা মাত্রই ১০/১৫ পৃষ্ঠায় সীমাবদ্ধ। যেমনি চেহারায়, তেমনি কথাবার্তায়, কবিতা পাঠে মজলিশে ও কবিগাণের আসরে ছিলেন রসিক মানুষ। বার্ধক্য বয়সে আশির দশকে পাটুয়াপাড়ায় ইন্তেকাল করেন। ত্রিশ চল্লিশ দশকের সুকন্ঠ গায়ক মোঃ নুরুল ইসলাম ছিলেন তারই পুত্র। তিনি আশির দশকে মৃত্যু বরণ করেন।

 

 

ডাঃ আনোয়ারা খাতুনঃ 

ক্ষেত্রীপাড়ার খাঁ বংশীয় চৌধুরী পরিবারের আত্মবংশীয় কৃতি কন্যা আনোয়ারা খাতুন দিনাজপুর তথা বাংলাদেশের প্রথম মুসলিম মহিলা ডাক্তার। ১৯৪২ সালে কলিকাতা থেকে এম বি পাশ করেন এবং পরে লন্ডন রয়েল কলেজ থেকে উচ্চতর ডিগ্রী লাভ করেন। তার আজীবন কর্মক্ষেত্র কলিকাতা। কলিকাতার পার্কভিউ নার্সিং হোম এর প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালিকা রূপে তিনি আজীবন মানুষের চিকিৎসায় নিয়োজিত থেকে প্রচুর খ্যাতি ও কৃতিত্বের অধিকারী। তার কৃতিত্ব জেলাবাসীরই গর্ব ও গৌরব। তিনি ১৯১৯ সালে জন্ম গ্রহন করেন।

 

 

রহিম উদ্দিন আহমদঃ

দিনাজপুর বারের লব্ধ প্রতিষ্ঠিত আইনজীবি রহিমউদ্দিন আহমদ ছিলেন দুটি যুগান্তকারী কর্মকান্ডের আলোকে দিনাজপুরের ইতিহাসে স্বনামধন্য। ২১ এর ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে দিনাজপুরের ভাষা বিপ্লবীদের কর্ণধার ছিলেন তিনি এবং পূর্ব পাকিস্তানে মুসলিম লীগ সরকারের যদৃচ্ছা শোষণ ও স্বৈরাচারী শাসনের বিরোধীতায় মওলানা ভাষাণীর ডাকে জেলা আওয়ামী লীগ গঠনের ভূমিকায় দুঃসাহসিক নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তিনিই। কাজেই তিনি একাধারে ছিলেন জেলা পর্যায়ে ভাষা আন্দোলনের ভাষা-সেনাপতি, তদ্রুপ জেলা পর্যায়ে আওয়ামী লগি সংগঠনের জনকও। দিনাজপুর জেলার তিনি প্রথম নেতা যার কন্ঠে ছিল বিপ্লবী প্রতিবাদী সুর এবং অযৌক্তিক ভিত্তিতে পাকিস্তান গঠিত হওয়ার পর থেকেই যার অবস্থান ছিল বিরোধীয় মঞ্চে। ১৯৫৩ সালে তারই নেতৃত্বে দিনাজপুর জেলা আওয়ামী লীগ গঠিত হয় এবং তার প্রথম সভাপতি হয়েছিলেন তিনি। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট দলের এম, পি হন। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ভাষা আন্দোলদের নেতৃত্ব দেয়ার রাষ্ট্রদ্রোহের অপরাধে জেলায় প্রথম কারারুদ্ধ হন। তার প্রতিবাদী নেতৃত্বেও জন্য বরাবর বিব্রতকর অবস্থায় ভুগতেন পাকিস্তানী জেলা প্রশাসক। কিন্তু জীবনের শেষ অধ্যায়ের কোন এক সময় থেকে রাজনৈতিক কর্মকোলাহলের প্রতি তার মানসিক স্বচ্ছন্দতাবোধের অভাব দেখা দেয়ায় তিনি রাজনীতি ছেড়েই দেন। বারের যোগাযোগটুকু রক্ষা করে চলেন শুধু। তিনি ১৯৮১ খ্রীষ্টাব্দেমৃত্যু বরণ করেন।

 

 

ডাক্তার নইমউদ্দিন আহমদঃ

ছাত্রজীবন থেকেই রাজনীতিমনা, স্বাধীনতাকামী ও সামাজিক উন্নয়নমুখী কর্মধারায় আজীবন সংশ্লিষ্ট ডাক্তার নইমউদ্দিন আহমদ জেলার একজন বিশিষ্ট ও সস্মানীয় ব্যক্তিত্ব। ১৯৪০ সালে তিনি কলিকাতা থেকে ডাক্তারী (এলএমএফ) পাশ করেন এবং পেশাগত দায়িত্ব পালন করা ছাড়াও আত্মনিয়োগ করেন রাজনৈতিক আন্দোলনের ধারায় ও সমাজসেবা কাজে। সময়টা ছিল কংগ্রেস, লীগ ও তেভাগা আন্দোলনের লক্ষ্যে পৌছানোর চূড়ান্ত সক্রিয়তার যুগ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ১৩৫০ এর মতান্তরে ৪৭ এর দেশ ভাগাভাগির মত বহু বিপর্যয়কর ঘটনায় তখন চলছিল জাতীয় যুগসন্ধিক্ষণ। এই বিক্ষুব্ধ পটভূমিতে ডাঃ আহমেদের রয়েছে প্রচুর অবদান। পাকিস্তানী আমলে ও স্বাধীনোত্তর যুগে জেলার যাবতীয় দুর্দিনে ও প্রয়োজন বিভিন্ন কর্ম প্রাঙ্গনে তার ভূমিকা প্রশংসীয়। তিনি জেলা আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠার (১৯৫৩) অন্যতম, ১৯৫৪ সালে যুক্ত ফ্রন্ট গঠনের সেক্রেটারী, জেলা পরিবার পরিকল্পনা সমিতির সভাপতিসহ অনেক সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত। স্বীয় পেশায়  অমনোযোগী হয়েও এসব কাজ ও ঝামেলার মধ্যেও তার রোগ নির্ণয়ে সুক্ষ্মতা আশ্চর্যজনক। তার জন্ম ১৯৯৪ সালে। তিনি শহরের ষষ্টীতলা মহল্লার বাসিন্দা।

 

 

লায়লা সামাদঃ

সুসাহিত্যিক আমিনুল হকের কৃতি কন্যা লায়লা সামাদ ছিলেন দিনাজপুরের গর্ব ও গৌরব। যেকালে বাংলাদেশের সম্ভ্রান্ত মুসলমান নারীরা উচ্চ শিক্ষা বঞ্চিত ছিল, মুক্ত আলো-বাতাসের পরিবর্তে সাধারণ ভদ্র পরিবারে নারীরা বাধ্য ছিল গৃহপ্রাচীরের অন্তরালে জীবন কাটাতে, প্রায় অবরোধবাসিনী হয়ে-সেই কুসংস্কার শাসিত দিনেও লায়লা সামাদ হতে পেরেছিলেন উচ্চশিক্ষিতা, লেখিকা, সাংবাদিক, নৃত্যশিল্পী এবং উন্মুক্ত খেলার মাঠের একজন অপ্রতিদ্বন্দ্বী বিজয়িনী ব্যাটমিন্টন খেলোয়াড়। তিনিই বাংলাদেশের প্রথম নারী সাংবাদিক যিনি কলিকাতা বিশ্বদ্যিালয় থেকে সাংবাদিকতায় উচ্চ ডিগ্রী লাভ করেন (১ম স্থান অধিকার করে) অনন্যা নামে একটি মাসিক পত্রিকায় সম্পাদিকা ছিলেন এবং রচয়িতা ছিলেন অনেকগুলি মানসম্পন্ন গ্রন্থের। তিনি বরাবর দৈনিক সংবাদ এর সাংবাদিকতায় সংশ্লিষ্ট ছিলেন। তার রচনায় ও সাংবাদিকতায় নারীমুক্তি আন্দোলনের দৃপ্ত আহবান অনুরণিত। তিনি ১৯৮৯ খ্রীষ্টাব্দে মৃত্যু বরণ করেন।

 

 

এ বি এম আব্বাসঃ

আন্তর্জাতিক পানি সম্পদ বিশেষজ্ঞ এ বি এম আব্বাস একজন ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন। যেকালে দিনাজপুরবাসী মুসলমান সমাজে ইঞ্জিয়ারিং পাশ করা উচ্চ শিক্ষিত ছিল সামান্যই। সেচ বিজ্ঞানে তার মেধা, জ্ঞান, প্রজ্ঞা ও বাস্তব অভিজ্ঞতা এত বেশ ছিল যা ইতিহাসে দৃষ্টান্তবিরল । বাংলাদেশের মত ছোট তথা দরিদ্র দেশের জন্য তিনি ছিলেন যেমন গর্ব ও গৌরব-যুগপতভাবে তেমনি বিশ্বের অনেক উন্নত ও শীর্ষস্থানীয় দেশের জন্য ঈর্ষার কারণ। তার চাকুরী জীবন শুরু বৃটিশ আমলের শেষ যুগে, অতঃপর পাকিস্তান ও স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম পর্বে তিনি সেচ বিভাগে চাকুরীরত ছিলেন। এমনকি প্রায় প্রত্যেকটি সরকারের সেচ সংক্রান্ত উপদেষ্টার পদ অলংকৃত করেন তিনি। এছাড়া দায়িত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করার ফাকে ফাকে গভীর পড়াশোনা ও গবেষণার মন নিয়ে প্রচুর অভিজ্ঞতা ও কর্মক্ষেত্রে বাস্তবতা অর্জন করতে পারার ফলশ্রুতিতে তার পক্ষে সেচ বিষয়ক অনেক মূল্যবান প্রতিবেদন, নিবন্ধ ও গ্রন্থ রচনা করতে পারা সম্ভব হয়। তার প্রণীত ফারাক্কা বিষয়ক গ্রন্থটি আন্তর্জাতিক মানের একটি অবিস্মরণীয় অবদান। তেমনি দিনাজপুরের ইতিহাসে এক মাত্র ব্যক্তিত্বের অধিকারী, যিনি আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন মহাসম্মান ভূষিত। তিনি শতায়ু ছিলেন। তিনি ১৯৯৭খ্রীষ্টাব্দে মৃত্যু বরণ করেন।

 

 

সুসাহিত্যিক আমিনুল হক (খাঁন বাহাদুর)

খ্যাতনামা উপন্যাসিক, নাট্যকার ও সরকারী উচ্চতর কর্মকর্তা আমিনুল হক ছিলেন মির্জাপুরের মির্জা বংশের অন্যতম কৃতি সন্তান। তিনি ছিলেন বহু সংখ্যক মূল্যবান গ্রন্থের লেখক। বিভাগপূর্ব যুগে টাইগার হিল উপন্যাস লিখে প্রচুর সুনাম অর্জন করেন। চাকুরী থেকে অবসর জীবনে তিনি লেখেন অনেক গ্রন্থ। তন্মধ্যে যার ভাগ্যে যা ছিল কাফের (নাটক) প্রভৃতি তার উল্লেখযোগ্য রচনা। বিশিষ্ট সাংবাদিক ও লেখিকা লায়লা সামাদ তার কন্যা ছিলেন। নওরোজ সাহিত্য মজলিশের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ও স্থানীয় নাট্যাভিনয়-এর সঙ্গে জড়িত আমিনুল হকের দুঃসাহসিক চেষ্টায় তার রচিত সংঘর্ষ নাটকে প্রথম নারী শিল্পীর অভিনয় এর প্রবর্তন হয় দিনাজপুরের নাট্যমঞ্চে (১৯৫৪)। দিনাজপুর রঙ্গমঞ্চের ইতিহাসে এটা ছিল তারই প্রথম কৃতিত্ব। তিনি বিভিন্ন মহলের সম্মানীয় ব্যক্তি ছিলেন। অত্যন্ত অত্যাধুনিক ও পরিচ্ছন্ন রুচিবোধ প্রভৃতি আচরণ প্রিয়তার কারণে আমিনুল হককে বলা হতো Most unpopularly popular man in Dinajpur। তিনি ১৯৬০ খ্রীষ্টাব্দে মৃত্যু বরণ করেন।

 

 

 

হাসান আলীঃ

জেলাবাসী মুসলমান সমাজের প্রথম এম এ এবং প্রাথমিক মুসলমান আইনজীবিদের মধ্যেও অন্যতম বিশিষ্ট আইনজীবী; তদুপরি জেলা মুসলিম লীগ আন্দোলনের সর্বাধিক নাম পরিচিতি পান জনপ্রিয় নেতা ছিলেন হাসান আলী। তিনি দীর্ঘকাল জেলা মুসলিম লীগের সভাপতি ছিলেন। তার লীগপ্রিয়তা ছিল এমনই অকৃত্রিম যে-তার কালে জেলা মুসলিম লীগ বলতে বুঝাতো হাসান আলী কিংবা হাসান আলী বলতে বুঝাতো মুসলিম লীগ। ১৯৪৬ সালের পাকিস্তান অর্জনের লক্ষ্যে প্রাদেশিক আইন সভার গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনে তার নিরুঙ্কুশ বিজয় লাভের কৃতিত্বেই তার প্রমাণ পাওয়া যায়। এমপি হওয়া ছাড়াও তিনি নবস্থাপিত পাকিস্তানের প্রাদেশিক মন্ত্রী পদ লাভ করেন। এক পর্যায়ে তিনি জেলা বোর্ডের চেয়ারম্যান, দিনাজপুর হাইমাদ্রাসার সভাপতি ও মাসিক নওরোজ পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। তার ব্যক্তি জীবনের সর্বাধিক বৈশিষ্ট্য ছিল তিনি একজন মন্ত্রী হয়েও ছিলেন কঠোর আদর্শবাদী, নীতিপরায়ন ও মনে প্রাণে ধর্মপরায়ন যার জন্য কোন প্রকারের লোভ লালসা বা অবৈধ আসকক্তি তথা সামান্যতম অন্যায় তাকে স্পর্শ করতে পারেনি। শত ব্যস্ততার মধ্যেও  তিনি ছিলেন জ্ঞানসাধক এবং শেষ বয়সেও পালন করে গেছেন আইন কলেজের অধ্যক্ষের দায়িত্ব। জেলা বোর্ড নির্মিত হাসান আলী হল তদীয় নামের অমর স্মৃতি। তিনি ১৯৮৫ খ্রীষ্টাব্দে মৃত্যু বরণ করেন।

 

 

ফুটবলের যাদুকর সামাদঃ

যদিও জন্মস্থান দিনাজপুরে নয়, তবে প্রবাদ ও জনশ্রুতি আছে যে, এককালের ফুটবলের মকুটবিহীন সম্রাট সামাদের ফুটবল খেলার হাতে ঘড়ি হয় দিনাজপুরের বড় মাঠে। এমনকি তার শেষ খেলাটিও প্রদর্শিত হয় এই বড় মাঠেই (১৯৪৫)। তার জন্ম স্থান পূর্ণিয়া (১৮৯৫)। রেল কর্মচারী ছিলেন পেশা জীবনে। তার মূল খেলাভূমি ছিল কলকাতা। বাংলাদেশের অধিকাংশ জেলাতে খেলেছেন তিনি। তাছাড়া খেলেছেন পৃথিবীর অনেক দেশে এবং দেশী বিদেশী অনেক হাড্ডাহাড্ডি প্রতিযোগীতায়। কিন্তু তার দল কোথাও পরাজিত হয়নি। ইহা সম্ভব হয়েছিল শুধু তার ঐন্দ্রজালিক ক্রীড়া নৈপূণ্যের কারণে। ইচ্ছামাফিক তিনি গোল করতেন যতটা দরকার ততটা। তার একটিও কম নয় বেশীও নয়। তার দেয়া লক্ষ্যভেদী গোল ব্যর্থ হয়েছে বলে প্রমাণ নাই। তাই তিনি হতে পেরেছিলেন বিশ্ববিজয়ী ফুটবলার। সে মহা সম্মানটি আজো অর্জিত ফুটবলের ইতিহাসে। দিনাজপুরের পার্বতীপুর রেলওয়ে শহরে তার শেষ বসবাস। এখানেই অতি দীনহীন অবস্থায় মৃত্যু এবং কালীবাড়ী গোরস্থানে অন্তিম শয়ান। সামান্যভাবে নির্মিত একটি সমাধিসৌধ বহন করছে তার অসমান্য গৌরময় জীবনাট্যের অসমান্য নির্বাক উপাখ্যান। তিনি ১৯৬৪ খ্রীষ্টাব্দে মৃত্যু বরণ করেন।

 

 

আলহাজ্ব হেমায়ের আলী টি.কেঃ

খাজা নাজিমউদ্দিন মুসলিম হল ও লাইব্রেরীর প্রতিষ্ঠাতা হেমায়েত আলী লালবাগ মহল্লার অধিবাসী আদালতের সেরেস্তাদার ছিলেন। জনকল্যাণমূলক একটি বিশিষ্ট কাজ করতে পারায় দেশের ইতিহাসে তিনি একজন স্বনামধন্য ব্যক্তিত্ব। ত্রিশের দশকে তার চেষ্টায় একটি লাইব্রেরী প্রতিষ্ঠার সূচনা হয় (১৯৩৩) যখন দিনাজপুর শহরে মুসলমানদের জ্ঞানচর্চার স্বতন্ত্র কোন জ্ঞাণপীঠ ছিল না। এমন কি ছিল না অন্য কোন সামাজিক প্রতিষ্ঠান। অসংখ্যা বাধা বিপত্তি; বিশেষ করে আর্থিক সংকট উৎরিয়ে তিনি যে প্রতিষ্ঠানটি গড়তে সক্ষম হন তা শুধু জেলার নয় দেশের গৌরব বটে। কোন সামাজিক কাজে আজীবন নিবেদিত প্রাণ ব্যক্তিত্ব রূপে তিনি জেলার ইতিহাসে অদ্বিতীয়। ১৯৪১ সালে তারই উদ্যোগে মাসিক নওরোজ পত্রিকা বের হয়, তদুদ্দেশ্যে স্থাপিত নওরোজ প্রিন্টিং প্রেস (লিঃ) ১৯৫০ সালে যখন আমিনুল হক সাহেবকে সভাপতি ও মেহরাব আলীকে সম্পাদক করে নওরোজ সাহিত্যে মজলিস স্থাপিত হয়, তিনি হন তার প্রধান পৃষ্ঠপোষক। ১৯৬৮ সালে যখন জেলা প্রশাসক আঃ কাঃ মঃ যাকারিয়া ও মেহরাব আলীর যৌথ প্রচেষ্টায় দিনাজপুর যাদুঘর প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয় সেক্ষেত্রেও তার পৃষ্ঠপোষতা ছিল সর্বপ্রথম। ১৯৫৪ সালে তার আজীবন নিঃস্বার্থ সমাজ সেবার স্বীকৃতি স্বরূপ নওরোজ সাহিত্যে মজলিশ কর্তৃক বোস্তান হলে আয়োজিত সাহিত্যে সম্মেলনে আনুষ্ঠানিক ভাবে তাকে নাগরিক সম্বর্ধনা দেয়া হয়, তৎসঙ্গে দেয়া হয় কিছু মূল্যবান উপহার। যেহেতু তিনি ছিলেন জেলাবাসীর জ্ঞাচর্চার প্রাণ পুকুরষ। সমকালীন রাজনীতির প্রেক্ষিতে তার মধ্যে বশী মাত্রায় পাকিস্তান প্রীতি থাকায় পুরস্কার স্বরূপ পাক সরকার কর্তৃক তিনি টি,কে উপাধি ভূষিত হন। মৃত্যুঃ ১৯৬৯।

তিনি ১৯৬৯ খ্রীষ্টাব্দে মৃত্যু বরণ করেন।

 

 

মহর্ষি ভবন মোহন করঃ

মহর্ষি নামে প্রসিদ্ধ এই মহান ব্যক্তি বাংলা স্কুলের পন্ডিত ছিলেন। ঢাকা থেকে শিক্ষকতার চাকুরী নিয়ে দিনাজপুর আসেন (১৮৬২) এবং শিক্ষকতার পাশাপাশি মানবিক সেবক রূপে আত্মনিয়োগ করেন। বিনামূল্যে হোমিওপ্যাথী চিকিৎসা ও ব্রাক্ষমতের প্রচার এ দুটো কাজেরই তিনি ছিলেন এতদঞ্চলের পথিকৃৎ। ব্রাক্ষমতের প্রচারে সাফল্য লাভ করতে না পারলেও স্থানীয় অঞ্চলে শিক্ষা বিস্তার ও বিনামূল্যে লোকের বাড়ী বাড়ী গিয়ে স্বেচ্ছায় হোমিও চিকিৎসা বিতরণের মাধ্যমে জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে আর্তমানবতা সেবায় আত্মদানের যে আদর্শ প্রতিষ্ঠা করে গেছেন তার জন্য তিনি যুগের ইতিহাসে মহর্ষি নামে পরিচিত। সকলের চেষ্টায় বালুবাড়ীতে একটি হোমিও দাতব্য চিকিৎসালয় স্থাপিত হয় (১৮৮৬), যা আজো তারই অমর নামের স্মৃতি বহন করছে। তিনি ১৯২৭ খ্রীষ্টাব্দে মৃত্যু বরণ করেন।

 

 

তাজউদ্দিন আহমদঃ 

দিনাজপুরে বারের লব্ধ প্রতিষ্ঠিত আইনজীবী তাজউদ্দিন আহমদ ১৯২৬ সালে আইন পাশ করে বারে যোগদান করেন এবং এই ব্যবসায়ে লিপ্ত ছিলেন আমৃত্যু যার স্থিতিকাল অনধিক ৪০ বছর। তিনি যখন বারে যোগদান করেন তখন মুসলমান আইনজীবি ছিলেন মুষ্ঠিমেয়। মুসলমান সংখ্যা গরিষ্ঠ এ জেলায় বিজ্ঞ আইনজীবীর পক্ষে খ্যাতি অর্জন করতে পারার ক্ষেত্রে প্রথম থেকেই অনুকুল ছিল। আইন শাস্ত্রে জ্ঞানের গভীরতা, মেধা, নিষ্ঠা ও চাতুর্যের কারণে আইন ব্যবসায়ে তার সুনাম ছড়িয়ে পড়ে। তিনি প্রথম শ্রেণীর আইনজীবী পর্যায়ে অধিষ্ঠিত হন। দিনাজপুর বার ছাড়াও উত্তরবঙ্গের অনেক জেলা বারে তার চাহিদা ও নামডাক ছড়িয়ে পড়েছিল। যে বৈশিষ্ট্যের কারণে তিনি সাফল্যের দ্বারে পৌছতে সক্ষম হন তা এই যে, তিনি ছিলেন মনে প্রাণে আইনজীবি বা আইনব্যবসায়ী। অন্যকোন পেশা, নেশা অর্থাৎ পার্শ্ব প্রবণতা তার মধ্যে ছিল না। যেমন অনেক আইনজীবি ছিলেন, একালেও আছেন যারা মূল পেশার পাশাপাশি অন্য কোন পেশায় আকৃষ্ট; বিশেষ করে রাজনীতি চর্চায়। তার এরূপ মনোবিকলন ছিল না। তার আইন ব্যবসায়ে সাফল্য লাভের এটাই ছিল কারণ। সেতাবগঞ্জ থানার মোল্লাপাড়ার চৌধুরী বংশোদ্ভুত তাজউদ্দিন শহরে মুন্সীপাড়া মহল্লায় বসবাসের পাকা ভবন নির্মাণ করেন। সুপ্রিম কোর্টের ভূতপূর্ব প্রধান বিচারপতি এ টি এম আফজাল তারই দেশগৌরব পুত্র। তিনি ১৯৭৭ খ্রীষ্টাব্দে মৃত্যু বরণ করেন।

 

 

ওস্তাদ কসির উদ্দিন আহমদঃ

তবলা সঙ্গীতের অসাধারণ গুণী ওস্তাদ কসির উদ্দিন শহরের পাটুয়াপাড়ার অধিবাসী ছিলেন। ১৯৪৭ এর দেশ বিভাগের ফলে হিন্দু সঙ্গীত শিল্পীগণ উদ্বাস্ত হয়ে চলে যাওয়ার ফলে শহরের সঙ্গীত ক্ষেত্রে যখন অচলায়তন সৃষ্টি হয় এবং সাধারণ মুসলমানগণ যখন গান বাজনার প্রতি চরম বিপক্ষ অবস্থানে ছিল তখন যে সামান্য দু’একজন কলাবিদ সঙ্গীতের আসর গড়ে তুলতে সৎসাহসের পরিচয় দেন, ওস্তাদ কসির উদ্দিন ছিলেন তাদের অন্যতম পথিকৃৎ। আশির দশকে তিনি দেহত্যাগ করেন। প্রাথমিক কর্মজীবনে পুলিশ বিভাগে চাকুরী করতেন।

 

 

নুরুল হুদা চৌধুরীঃ

রাজরামপুর চৌধুরী পরিবারের বিশিষ্ট উত্তরাধিকারী নুরুল হুদা চৌধুরী মুসলিম লীগ সংগঠন ও আন্দোলনের পরিমন্ডলে একজন খ্যাতিমান ব্যক্তি। যে কালে শহর ছাড়া গ্রামাঞ্চলে কোন হাইস্কুল গড়ে উঠেনি, সে সময়ের বন্ধ্যা সমাজের পতিত ভূমিতে তার পিতা শরফুদ্দিন চৌধুরীর দ্বারা ১৯১৩ সালে ঐ গ্রামে একটি হাইস্কুল স্থাপিত হয়। গৌরবের কথা এই যে, নবস্থাপিত ঐ স্কুলে কিছু দিন শিক্ষকতা করেছিলেন স্বনামধন্য শিক্ষাবিদ ও মনীষী ডক্টর মুহম্মদ শহিদুল্লাহ। নূরুল হুদা চৌধুরী যদিও মনে প্রাণে রাজনীতিসেবী ছিলেন কিন্তু তার রজনীতি চর্চায় আত্মপ্রচার প্রবণতা ছিলনা-ছিল না হৈ চৈ করে পদ ও পদবী দখলের দুরাকাঙ্খাও। তার কর্মফলই তাকে রাজনৈতিক ভাগ্যোন্নতির সুযোগ করে দেয়। বরাবর জেলা মুসলিম লীগের সহ-সভাপতি, জেলা বোর্ডের ভাইস চেয়ারম্যান, রেডক্লিফ রোয়েদাদ মিশনের প্রতিনিধি সদস্য, ১৯৬৫ সালে এম এন এ সম্মানীয় পদে অধিষ্ঠিত হবার সৌভাগ্য হয় তার। রাজনীতি করে অনেকে যেমন সঞ্চয় করেন, তিনি করে গেছেন অসাধারণ ত্যাগ।

 

 

সেরাজউদ্দিন চৌধুরীঃ

জমিদারী আমলের টিপিক্যাল ব্যক্তিত্বের অধিকারী হয়েও একজন ব্যতিক্রমী স্বভাব ও লোক ব্যবহারে আদর্শ স্থানীয় ছিলেন ঘুঘুডাঙ্গায় চৌধুরী পরিবারের অন্যতম বিশিষ্ট সদস্য সেরাজউদ্দিন চৌধুরী। ১৯১৬ সালে ম্যাট্রিক পাশ করেন জিলা স্কুল থেকে। প্রজাদরদী, পরোপকারী ও লোকপ্রিয়তার তার সুনাম ছিল। সমকালীন জেলার মুসলমান চৌধুরীগণের মত তিনিও ছিলেন মুসলিমলীগ পন্থী নেতা তথা কর্মীও। রাজনীতি ক্ষেত্রে তার আত্মত্যাগ ছিল দৃষ্টান্তমুলক। ১৯৪৬ সালে প্রাদেশিক আইন সভার নির্বাচন হয়, যেটা ছিল পাকিস্তান অর্জনের লক্ষ্যে চুড়ান্ত শর্তপূর্ণ নির্বাচন। কেন্দ্রীয় লীগ মনোনীত প্রার্থী ছিলেন হাসান আলী। নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বীতায় সেরাজউদ্দিন চৌধুরীরও ফিল্ড ছিল সম্ভাবনায় উজ্জ্বল। কিন্তু সেমসাইড নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিবেচনায় হাসান আলীর অনুকূলে স্বীয় প্রার্থীতা প্রত্যাহার করেন। হাসান আলী বিজয়ী হন-প্রাদেশিক মন্ত্রীও হন। ঘুঘুডাঙ্গা সেরাজউদ্দিন ট্রাষ্ট তার স্মৃতিতে গঠিত একটি প্রতিষ্ঠান। তিনি ১৯৮০ খ্রীষ্টাব্দে মৃত্যু বরণ করেন।

 

 

ইয়াসির উদ্দিন আহমদ চৌধুরীঃ

জমিদারী আমলের জেলার অধিকাংশ মুসলমান চৌধুরীগণ যখন রাজস্ব আদায় ও হালগরু নিয়ে মগ্ন তখন একজন ব্যতিক্রমী চিন্তাধারার চৌধুরী ছিলেন নালাহারের কৃতি জমিদার নাসির উদ্দিন চৌধুরী। লোকালবোর্ড থেকে জেলাবোর্ড-এর সদস্য এবং এক পর্যায়ে ভাইস চেয়ারম্যানের পদ লাভ করেন তিনি (১৯৩৩) যখন জেলার চৌধুরী গোষ্ঠীর মধ্যে জোত জমি ও ধান চাষের ব্যস্ততা ছাড়া রাজনীতি, সমাজ চেতনা ইত্যাদি নিয়ে ভাবনার বালাই ছিল না, তখন তিনি নিরক্ষর জনসাধারণের মধ্যে শিক্ষা বিস্তার ও সামাজিক উন্নতির জন্য খুবই চেষ্টা করতেন এবং জেলা বোর্ডের ভাইস চেয়ারম্যান (১৯৩৩) এর পদে থেকে তিনি অনেক গ্রাম স্কুল, মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা ও অনেক স্কুল মাদ্রাসায় অনুদানের ব্যবস্থা করেন। জনদরদী, মিষ্টভাষী, পরোপকারী, অতিথিপরায়ন রূপে তার খুব সুনাম ছিল। তিনি পঞ্চাশের দশকে মৃত্যুবরণ করেন।

 

 

মেহেরাব আলী চৌধুরীঃ

জমিদারী যুগের আদর্শরূপী জমিদার ছিলেন গোবিন্দুপুরের মেহেরাব আলী চৌধুরী। জমিদারীসুলভ আভিজাত্য ও প্রচুর বিত্তবান অথচ অসামান্য অনাড়ম্বরপ্রিয়তা তথা মিতাচারীতায় ছিলেন এক আদর্শ চরিত্র। সমকালীন কুসংস্কার পীড়িত সমাজ ও মোল্লা শাসিত সাংস্কৃতির অনেক উর্দ্ধে তার ধর্মীয় চিন্তাধারার কথা শুনলে একালে বিশ্বাস করার কথা নয়। খুব শিক্ষিত না হয়েও তিনি যুক্তিবাদী ছিলেন এবং কোন ক্ষেত্রেই ছিলেন না অন্ধবিশ্বাসী কিংবা অতি ভক্তিবাদী। সংসার যাত্রায় তার একটা নিজস্ব ধারা ছিল যাতে ছিল রুচিশীলতা ও শিল্পমন্যতার পরিচয়। যেমন তার বাসভবনের প্রাঙ্গনে ছিল অত্যন্ত নিটোল নিখুঁত ভাবে ছনের ছাওয়া একটি সুলম্বি কাছারী ঘর যা দূর থেকে দেখে মনে হতো যেন কোন দক্ষ শিল্পীর পটে আঁকা একটি চিত্র। তার বাড়ীর সামনে নিপুণ ভাবে কারুকার্য খচিত গম্বুজ ও বহু মিনার শোভিত সুদর্শন মসজিদটি তার আমলে নির্মিত হয়। ইহা তার প্রগাঢ় শিল্প প্রিয়তার পরিচয় বহন করে। মসজিদের ইমাম রূপে ইরান থেকে আনীত একজন আলেমকে উপর্যুক্ত মাসহারায় নিযুক্ত করার মধ্যেও তার ধর্মপ্রাণতার পরিচয় নিহিত ছিল। তিনি ১৯৩৭ সালে মৃত্যুবরণ করেন।

 

 

হাজী আব্দুর রউফঃ

বেঙ্গল টেকনো নামের বিখ্যাত ঔষধ কারখানার নাম যারা জানে তাদের কাছে এর প্রতিষ্ঠাতা আবদুর রউফ এর নামটি অজানা থাকার কথা নয়। উৎপাদনশীল ব্যবসা বাণিজ্যে জেলাবাসী ব্যবসা বিমুখ মুসলমানদের পথিকৃৎ ছিলেন তিনি। চাকুরীর চেয়ে ব্যবসা বড় এমন একটি উৎসাহজনক প্রবাদ বাক্যে উজ্জীবিত হয়ে দিনাজপুরের তরুণ বিজ্ঞান গ্রাজুয়েট আবদুর রউফ কর্মজীবন শুরুর প্রথম পদক্ষেপে ঔষধ উৎপাদনশীল ব্যবসা শুরু করেন প্রথমে কলিকাতায় (১৯৩৩)। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্যবসায়িক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হওয়ায় সেখান থেকে ব্যবসা গুটিয়ে নিয়ে চলে আসেন নিজ জেলা দিনাজপুরে এবং পুনরায় পূর্ণদ্যোগে একই ঔষধ কারখানা খুলে বসেন শহরস্থিত বাসভবন বালুবাড়ীতে। এই বেঙ্গল টেকনো বর্তমানে অনধিক অর্দ্ধশতাব্দীর পুরাতন উত্তরাঞ্চলের একটি গৌরবময় শিল্প প্রতিষ্ঠান। তিনি ১৯৮৮ খ্রীষ্টাব্দে মৃত্যু বরণ করেন।

 

 

অধ্যক্ষ তসিরউদ্দিন আহমদঃ

একজন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, শিক্ষক ও অধ্যক্ষরূপে প্রশংসনীয় ব্যক্তিত্ব ছিলেন তসির উদ্দিন আহমদ। শিক্ষা ক্ষেত্রে ছিলেন অনুকরণীয় আদর্শ ও দক্ষ সংগঠক। দিনাজপুর শহরের শিক্ষা সংকটের এক বিশেষ মুহুর্তে আদর্শ কলেজের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ হিসেবে যোগ দেন। এর আগে দেওগাঁ হাই মাদ্রাসা, দিনাজপুর হাই মাদ্রাসা; বিশেষ করে বিরামপুর কলেজ প্রতিষ্ঠায় ও পরিচালনায় তিনি যে প্রাণান্তকার পরিশ্রম করেন তা ছিল সর্বজন প্রশংসিত। স্থানীয় বহু মেধাবী ছাত্রের উচ্চ শিক্ষায় তিনি স্বেচ্ছাকৃত অভিভাবকের ভূমিকা পালন করেন। যাদের মধ্যে অনেকেই শিক্ষাক্ষেত্রে জেলার মুখোজ্জল করেন। সমকালীন ঘটনা প্রবাহ সম্পর্কে তার স্মৃতি ছিল যেন ক্ষুদে বিশ্বকোষ। তিনি ছিলেন সাহিত্যেমোদী এবং ইসলামী সাহিত্যে মজলিশের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি (লুপ্ত)। ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধা মেজর মাহবুব (বীর উত্তম-মরণোত্তর) তারই কৃতিসন্তান। তিনি ১৯৮৫ খ্রীষ্টাব্দে মৃত্যু বরণ করেন।

 

 

ডক্টর গোবিন্দ চন্দ্র দেবঃ

ডক্টর গোবিন্দ চন্দ্র দেব সিলেট জেলায় ১৯০৭ খৃষ্টাব্দে জন্ম গ্রহন করেন। আজীবন তিনি ছিলেন মেধাবী ও অত্যন্ত বিদ্যানুরাগী। ১৯২৯ খৃষ্টাব্দে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রথম শ্রেণীতে ১ম হয়ে দর্শন শাস্ত্রে এমএ পাশ করেন। মুম্বাইতে কিছুদিন গবেষণা করেন, তারপর ত্রিশের দশকেই কলিকাতা রিপন কলেজে অধ্যাপকের চাকুরী। ১৯৪২ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের হিড়িকে দিনাজপুরে রিপন কলেজের ব্রাঞ্চ খোলা হলে তিনি দিনাজপুর ব্রাঞ্চ কলেজে আসেন। এসময় তিনি গবেষণা করে সম্মানীত ডক্টরেট উপাধি লাভ করেন। গবেষণার থিসিসটি গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হওয়ায় দার্শনিক রূপে তার সুনাম দেশ বিদেশে ছড়িয়ে পড়ে। ১৯৫৪ সালে রিপন কলেজ প্রত্যাহার হয়ে গেলে দিনাজপুরে নবস্থাপিত এসএন কলেজের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ হন। দিনাজপুরের নতুন কলেজের ভবন নির্মাণের পশ্চাতে তার অবিস্মরণীয় অবদান ছিল। ১৯৫৩ সালে দিনাজপুরে অধ্যক্ষ পদে ইস্তফা দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করেন এবং দর্শন বিভাগের অধ্যক্ষ হন। তারই চেষ্টায় উক্ত বিভাগের দর্শন ভবন নির্মিত হয়। তিনি ছিলেন সমন্বয়বাদী ও মানবতাবাদী দর্শনে বিশ্বাসী একজন আদর্শ মহামানুষ।

 

 

ফজলে হকঃ

দিনাজপুর জেলা কৃষক সমিতির দীর্ঘকালীন সভাপতি ফজলে হক মহব্বতপুর গ্রামের অধিবাসী ছিলেন। শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের স্নেহধন্য ফজলে হক ধনাঢ্য জোতদারদের সন্তান হয়েও আজীবন চিরবঞ্চিত প্জা সাধারণের স্বার্থে রাজনীতি করে প্রজাদরদী নেতা রূপে প্রচুর খ্যাতি অর্জন করেন। ড্রয়িংরুম রাজনীতি করার পরিবর্তে তার কর্মক্ষেত্র ছিল গ্রাম ও গ্রাম্য লোকজন। যখন তিনি সবেমাত্র তরুণ নেতা তখন মহারাজা বিরোধী একটি জমিদারী শোষণ মূলক ঘটনার বিরুদ্ধে নেতৃত্ব দিতে গিয়ে শহর ও গ্রামাঞ্চলে তার নামে জয় জয়কার পড়ে যায়। কোন অজ্ঞাত কারণে জমিদার কর্তৃক দক্ষিন কোতয়ালীবাসী প্রজাদের উপর টাকা প্রতি একআনা মাত্র কর বৃদ্ধি করা হয়। ফলে গ্রাম্য মরুববীদের সাহায্য সহযোগীতায় ফজলে হকের নেতৃত্ব শুরু হয় খাজনা বন্ধ আন্দোলন এবং তা স্থায়ী হয় দীর্ঘদিন। পরিশেষে মহারাজা স্বয়ং হাতীতে চড়ে গিয়ে প্রজাদের সাক্ষাৎ উপস্থিতিতে বর্দ্ধিত খাজনা প্রত্যাহার করতে বাধ্য হন। অনেক সামাজিক কাজের নেতৃত্ব দেয়া ছাড়াও ফজলে হক ছিলেন চেড়াডাঙ্গী হাইস্কুলের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। ফজলে হক দুবার প্রাদেশিক আইন সভা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দীতা করেন। ১৯৪৬ সালে লীগ মনোনীত প্রার্থী হাসান আলীর কাছে পরাজিত হন। পক্ষান্তরে ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের মনোনীত প্রার্থীরূপে শোচনীয় ভাবে পরাজিত করেন মুসলিম লীগ নেতা ও মন্ত্রী হাসান আলীকে। তিনি ১৯৮৯ খ্রীষ্টাব্দে মৃত্যু বরণ করেন।

 

 

দুর্গা মোহন রায়ঃ

যুক্ত ফ্রন্ট আমলে (১৯৫৪) এম পি হয়েছিলেন দুর্গামোহন রায়। দল বদল বা দল ছুট যুগের রাজনৈতিক চরিত্রে তিনি নির্লোভ নিঃস্বার্থ মানসিকতার অধিকারী এবং একনীতিবাদী ও এক মতাবলম্বী রাজনীতির পতাকাবাহী। বহু তফশিলী জনসংখ্যা অধ্যুষিত দিনাজপুর জেলায় বর্তমানে তিনিই একমাত্র বর্ষীয়ান নেতা। বিরোধী রাজনৈতিক চিন্তাধর্মী দুর্গা মোহন রায় যুগ চরিত্রের সঙ্গে নিজকে মানিয়ে নিতেনা পারায় কথায় ও কর্মে তিনি ছিলেন অত্যন্ত দুশ্চিন্তাগ্রস্থ। ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের সাংগঠনিক কাজে তার যথেষ্ঠ অবদান রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ও নিরপেক্ষ  ইতিহাস রচিত হোক-এ নিয়ে তার চেষ্টার কমতি ছিল না ।  তিনি বড়বন্দর নিবাসী এবং জন্ম ১৯১৩ সালে।

 

 

আফতাবউদ্দিন চৌধুরীঃ

বিখ্যাত রাজনৈতিক নেতা, বক্তা, সমাজকর্মী ও সুলেখক আফতাবউদ্দিন চৌধুরীর নামটি একসময় প্রবাদের মত পরিচিত ছিল সবার মুখে মুখে। একটি মাত্র গ্রন্থ লিখে যদি খ্যাতির অধিকারী হওয়া যায়, তেমনই একজন প্রচ্ছন্ননামা লেখক ছিলেন আফতাবউদ্দিন চৌধুরী। তার রচিত বইটির নাম অতীতের কথা। অতি মার্জিত ছাপায় বইটির দ্বিতীয় সংস্করণ বের হয় কলিকাতা থেকে (১৯৭২)। তিনি কংগ্রেস পন্থী রাজনীতি করতেন বলে তার একটি ব্যতিক ছিল যে-ভারতীয় কংগ্রেসের বার্ষিক সম্মেলন যে শহরে অনুষ্ঠিত হতো তিনি তার প্রত্যেকটি সম্মেলনে যোগদান করতে ছুটে যেতেন নিজ খরচায়। উল্লেখিত বইটি সেই অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান ও পর্যবেক্ষণের অবস্থান থেকে লেখা। ভাষা যেমন প্রাঞ্জল তেমনি মুগ্ধকর প্রকাশ ভঙ্গি ও আকর্ষণীয় ঘটনাবলী। তার রাজনৈতিক দর্শনে ৪৭ এর দেশ বিভাগ ছিল অবাস্তব ও অযৌক্তিক পরিকল্পনা যা তিনি নির্দ্বিধায় তদীয় গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন। নবাবগঞ্জ থানা নিবাসী হলেও তার নিত্য দিনের কর্মক্ষেত্র ছিল দিনাজপুর শহর। তিনি ১৯৮০ খ্রীষ্টাব্দে মৃত্যু বরণ করেন।

 

 

গুরুদাশ তালুকদারঃ

জন্মগত ভাবে রংপুরের অধিবাসী হয়েও সারাটা কর্মজীবন অতিবাহিত করেন দিনাজপুরে। দরিদ্র মানবতার স্বার্থে ও হিতার্থে কাজ করতে গিয়ে জমিদার পুত্র গুরুদাশ পৈতৃত্ব সম্পদ, বিলাস বৈভব অকাতরে বিসর্জন দিয়ে ত্যাগ তিতিক্ষার ইতিহাসে যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন তা ছিল নিঃসন্দেহে অসাধারণ। তার মুগ্ধ করা সদয় আচার আচরণ ও বজ্রের মত কণ্ঠনিঃসৃত আশার বাণী যেমন জনগণের মনে আশা আকাঙ্খার স্বপ্ন দেখাতো তেমনি ভীমের মত ভীমকায় চেহারা ও মেঘগর্জিত কন্ঠধ্বনি মহাত্রাসের সঞ্চার করতো অত্যাচারীদের মনে। তিনি তেভাগা আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা ছিলেন।

 

 

শ্রীমাধব চন্দ্র রায়ঃ 

দিনাজপুরে স্বদেশী আন্দোলন যুগের নিরবিচ্ছিন্ন ধারার একজন বিপ্লবী কর্মী ছিলেন হিলির মাধব চন্দ্র রায়। ১৯৩৩ সালের ইংরেজ সম্রাজ্য বিরোধী সশস্ত্র কর্মকান্ডের অন্যতম দুঃসাহসিক অগ্রপথিক তথা হিলির মেল ডাকাতীর চাঞ্চল্যকর ঘটনার নেপথ্য নায়ক ছিলেন তিনি। স্থানীয় অধিবাসী হিসেবে উক্ত সন্ত্রাসী কাজের গুপ্ত সংবাদ সংগ্রহ করা থেকে অপারেশনের পরামর্শ, অস্ত্রশস্ত্র সংগ্রহ ও সংরক্ষণ এবং যোগাযোগসহ যাবতীয় সরবরাহের কাজগুলি এমন সুকৌশলে সম্পাদন করেন যে, পুলিশ তা ঘুর্ণাক্ষরেও বুঝতে পারতো না। সন্দেহভাজন হিসেবে পুলিশ কর্তৃক ধৃত হন এবং হাজত বাস করেন একাধিকবার। আজীবন রাজনৈতিক আন্দোলনে লিপ্ত দীর্ঘজীবি মাধব চন্দ্র রায় সমাজ ও শিক্ষা ক্ষেত্রে কিরূপ সচেতন ছিলেন তার কর্মবলীতে তার পরিচয় নিহিত। তিনি লেখক ছিলেন এবং স্বীয় ঘটনাবহুল জীবনের বহু কথা প্রকাশ করে গেছেন বালুঘাট বার্তায়। তিনি ২০০০ খ্রীষ্টাব্দে মৃত্যু বরণ করেন।

 

 

হাজী মোহাম্মদ দানেশঃ

পরাধীন যুগের আলীগড়ের এমএ এবং এলএলবি হাজী দানেশ আজীবন বৈপ্লবিক রাজনৈতিক দর্শনের সংগ্রামী অনুশীলন ছাড়া আত্মসুখের জন্য জীবনে কিছুই করে যাননি। তিনি ছিলেন মানুষের সুখে দুঃখে ও প্রয়োজনে, অভাব অভিযোগের প্রতিবিধানের পটভূমিতে একজন আপ-খোরাকী স্বেচ্ছাকর্মী। এই অনন্য মানসিকতার জন্যই তিনি হতে পেরেছিলেন গণ মানুষের মুক্তিদাতা নেতা। রাজনৈতিক আন্দোলনের পরিবর্তে তার সংগ্রাম ছিল অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যার্জনে। কৃষক সমিতির মাধ্যমে ১৯৩৭ সালে রাজনীতিতে তার প্রথম পদার্পন। ৪৬ এর তেভাগা আন্দোলনে তিনি একটি চিরস্মরণীয় কিম্বদন্তী। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে তিনি যুক্তফ্রন্ট ভূক্ত এমপি হন। তখন দেশময় তার জনপ্রিয়তার স্বর্ণযুগ। সেই সুবাদে মন্ত্রী হওয়ার উজ্জল সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু তার কর্মধারায় অতিমাত্রায় কমিউনিষ্ট গন্ধ থাকায় তা হতে পারেননি। একনীতির কট্টোরপন্থী নেতা হয়েও শেষ জীবনের কতিপয় কর্মকান্ডে; বিশেষ করে স্বৈরাচারী শাসনের প্রক্রিয়ার সঙ্গে সংম্পৃক্ত হয়ে পড়ায় বড় বেশী বিতর্কিত হয়ে পড়েছিলেন তিনি। অনেক স্পষ্টবাদীর মতে-তার দৈহিক মৃত্যু না হতেই তার সুদীর্ঘ বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের মৃত্যু হয় আগে ভাগেই। দিনাজপুরের হাজী মোহাম্মদ দানেশ কৃষি ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় তারই নামে অমর স্মৃতি। তিনি ১৯৮৫ সালে মৃত্যুবরন করেন।

 

 

ডক্টর আফতাব আহম্মদ রহমানীঃ

অসাধারণ মেধা ও ব্যুৎপত্তির অধিকারী ডক্টর রহমানী ছিলেন বাংলাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ট আরবী ভাষা পন্ডিত। প্রধানতঃ আরবী মাদ্রাসার ছাত্র রূপেই তার শিক্ষাজীবন শুরু। অতি কৃতিত্বের সঙ্গে দিল্লীর উচ্চ আরবী মাদ্রাসা থেকে (রহমানীয় মাদ্রাসা) পাশ করার পর বাংলাদেশ বিএ অনার্স ১ম শ্রেণীতে প্রথম (গোল্ড মেডালিস্ট), এমএ ১ম শ্রেণীতে প্রথম, অতঃপর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি(১৯৬৮), ইংলন্ডের কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি (১৯৭০) প্রভৃতি উচ্চতর ডিগ্রী লাভ করার পর তার সাংসারিক জীবন ও কর্মজীবনের শুরু। ডক্টর রহমানী শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চতম ডিগ্রীধারীই ছিলেন না, যুগপত ভাবে আরবী ভাষা ও ইসলামী শাস্ত্রে ছিলেন এমন প্রাজ্ঞ ও পন্ডিত যার সমকক্ষ আরবী শিক্ষাবিদ সমকালীন দেশে দ্বিতীয় জন ছিলেন বলে মনে হয়না। জন্মগত ভাবে তিনি ছিলেন বিরল থানার অধীন মুরাদপুর গ্রামের এক মধ্য নিম্ন বিত্ত সম্ভ্রান্ত পরিবার থেকে আসা দেশের কৃতি সন্তানগণের অন্যতম। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবী ভাষার অধ্যাপক, একাধিকবার বিভাগীয় প্রধান, মাদ্রাসা শিক্ষাবোর্ড, জাতীয় যাকাত বোর্ড এর সদস্য ছাড়াও সামাজিক অনেক কাজের সঙ্গে জড়িত থেকে ডক্টর রহমানী সুলেখক ও এক পর্যায়ে মাসিক তর্জমানুল হাদিস পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। অনেক পত্র পত্রিকায় অনেক লেখা প্রকাশিত হলেও গ্রন্থাকারে কোন বই প্রকাশিত হয় নাই। রেখে গেছেন অনেক পান্ডুলিপি, বিশেষ করে ডক্টরেট পাওয়া অপ্রকাশিত থিসিসটি। বস্ত্ততঃ প্রতিভার সঙ্গে পরিশ্রম ও উচ্চ লক্ষ্যের সঙ্গে উচ্চাশা মানুষকে জীবন যুদ্ধে কিভাবে সৌভাগ্যের শীর্ষেনিয়ে যায় ক্ষণজন্মা ডক্টর রহমানী তার কিছু দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন। তিনি ১৯৮৪ খ্রীষ্টাব্দে মৃত্যু বরণ করেন।

 

 

মাওলানা জহির উদ্দিন নূরীঃ

খেলাফত আন্দোলনের উত্তরকালের প্রসিদ্ধ আলেম (দিল্লীর মাদ্রাসা পাশ) জহির উদ্দিন নূরী তীব্র কন্ঠের ইসলামী বক্তারূপে পরিচিত ছিলেন। জেলা মুসলিম লীগের ক্ষেত্রভূমি সৃষ্টিতে তার উল্লেখযোগ্য অবদান ছিল। গ্রাম্য রাজনীতি বিশারদ মওলানা কর্মজীবনের এক পর্যায়ে ইউনিয়ন বোর্ড চেয়ারম্যানও হয়েছিলেন। অসাধারণ বাকপটু মওলানার সাধারণ কথাবার্তায় ও মঞ্চের বক্তৃতায় ছিল এমন সব হাস্যরসের ভান্ডার। সেই সঙ্গে তিক্ত ব্যাঙ্গ বিদ্রুপের বুকভাঙ্গা কষাঘাত, যা শ্রবণ করা শ্রোতাকে হাস্যরসে ভাসিয়ে দিতো, সেই সঙ্গে চিতিয়ে তুলতো মানবিক মূল্যবোধ ও ধর্মীয় উম্মাদনা। মওলানা অত্যন্ত জনপ্রিয়, সংগঠনশীল ও নেতৃত্বমনা ব্যক্তি ছিলেন। তিনি গ্রামাঞ্চলে অনেক মক্তব-মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করে জনসাধারণকে শিক্ষা সচেতন করতে পরিশ্রম করেন। তিনি ১৯৮৯ খ্রীষ্টাব্দে মৃত্যু বরণ করেন।

 

 

ডাঃ ওয়াসিমুদ্দিন খাঁনঃ

বৃটিশ আমলের শেষ দিকে একমাত্র মুসলমান এম, বি পাশ ডাক্তার ছিলেন। চিকিৎসা ব্যবসার সঙ্গে সঙ্গে মুসলিম লীগ রাজনীতিও করতেন। শেস দিক চিকিৎসা রাজনীতি ছাড়াও অধিকতর মনোযোগী হয়ে পড়েন ব্যবসায়। তিনি বিরাট কাঠ চেড়াই ব্যবসার মালিক ছিলেন। তিনি ১৯০৩ খ্রীস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৯৬৬ খ্রীষ্টাব্দে মৃত্যু বরণ করেন।

 

 

খতিব উদ্দিন আহমেদঃ

বিরল থানার অধিবাসী, সম্ভ্রান্ত বংশীয় সন্তান, খুব বেশী শিক্ষিত না হয়েও কুসংস্কারমুক্ত ভাব প্রবণতায় ছিলেন আলোড়িত। মানসিকভাবে কিছুটা কল্পনাপ্রবণ এবং অনেকটা বাস্তববাদী। গ্রামের যুবকদের নিয়ে সমিতি, পাঠাগার, ফুটবল টীম, স্কুল প্রভৃতি সংগঠনের অগ্রণী ছিলেন। যখন গ্রাম্য চিন্তাধারায় এসব নবীণ সংস্কৃতির কথা ছিল অপূর্ব। চল্লিশের দশকে শহরে তিনি অভিবাসিত হন। যোগদান করেন স্বৈরাচারী পাক সরকারের বিরুদ্ধেচারীতার প্রথম স্বাপ্লিক মওলানা ভাষানীর বৈপ্লবিক আন্দোলনে। মাওলানার ডাকে দিনাজপুরে বিরোধীয় দল গড়ার স্বপ্ন দেখা শুরু হয়। কিন্তু স্বপ্ন, কল্পনা ও বাস্তবতা এক কথা নয়,  বিশেষ করে ঐ সময় সরকার বিরোধী দল গঠন করা। কিন্তু মওলানাকে ঠেকায় কে? ঢাকায় কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ গঠিত হয়, দিনাজপুরের জেলা শাখা গঠিত হয় নির্ভিক নেতা রহিম উদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে। কিন্তু দলভারী করতে ভয়ানক সমস্য সংকট দেখা দেয়। স্বৈরাচারী শাসকের ভয়ে সে সময় যে সামান্য কজন অকুতভয় জেলা আওয়ামীলীগ গড়তে সাহসী কর্মশক্তির পরিচয় দেন, খতিব উদ্দিন আহমেদ ছিলেন অন্যতম। তিনি শহর আওয়ামী লীগের সেক্রেটারী নির্বাচিত হন। একজন নিবেদিত কর্মী রুপে জড়িত ছিলেন আওয়ামী লীগের সঙ্গে। তিনি ১৯৭১ খ্রীষ্টাব্দে মৃত্যু বরণ করেন।

 

 

এস এ বারীঃ

শুধু ভাষা সৈনিক নয়-বরং ভাষা সেনাপতি রুপে মর্যাদা দেয়া হলে সম্যক পরিচয় দেয়া হয় এসএ বারীর। বাহাদুর বাজার মহল্লা দুর্দান্ত ছেলে বারী ছাত্রজীবনে যেমন তেমন বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে, ততোধিক দুর্দান্ত ছিলেন ভাষা আন্দোলনেও। রাজনৈতিক জীবনেও ছিলেন ড্যাশিং পুশিং প্রকৃতির নেতাদের অন্যতম। ২১ এর ১৪৪ ধারা ভঙ্গকারী ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী ও পুলিশের প্রতিরোধ ভঙ্গকারীদের একজন। এমনকি ৪৮ এর রাষ্ট্র ভাষার প্রশ্নে কায়েদ আযম ঘোষিত হটকারী সিদ্ধান্তটির বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ নিক্ষেপকারী ছাত্র নেতাদের অন্যতম ছিলেন দিনাজপুরের গৌরব এসএ বারী। আজীবন রাজনীতি সচেতন এসএ বারী ছাত্রজীবনে ছাত্র ইউনিয়নের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য, পরে  ডাকসুর ভিপি (১৯৫৪) নির্বাচিত হন। এছাড়া তিনি ছিলেন অনেক ছাত্র সংগঠনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। মওলানা ভাসানীর অকৃত্রিম স্নেহধন্য এসএ বারী বৃহত্তর ও উচ্চতর রাজনৈতিক জীবনে পূর্বাপর ছিলেন একনিষ্ঠ ন্যাপপন্থী নেতা। দলছুট নেতৃসুলভ প্রবৃত্তির ও ষড়যন্ত্রমূলক কুটনীতির অনেক উর্দ্ধে ছিল তার রাজনৈতিক অবস্থান। এক পর্যায়ে তিনি বাংলাদেশ সরকারের উপদেষ্টা ও পরবর্তীতে উপ-প্রধানমন্ত্রী হন। জেলা বারের লব্দ প্রতিষ্ঠ আইনজীবি এবং সাহিত্যমোদী ছিলেন। ক্ষমতাকে লোভনীয় উপার্জনের হাতিয়ার রূপে ব্যবহার করার পরিবর্তে পরোপকারীতা ছিল তার বিবেকের তাড়না। মানুষ রূপে ছিলেন জনদরদী, সৎ, অকপট ও মুক্ত মনের ব্যক্তিসত্বার অধিকারী। তার জীবনাবসানের পর জেলা পরিবার পরিকল্পনার সমিতি কর্তৃক ঘাসীপাড়ায় নির্মিত এসএ বারী হলটি তার নামে উৎসর্গীত হয়। তিনি ১৯৮৭ খ্রীষ্টাব্দে মৃত্যু বরণ করেন।

 

 

এ্যাডভোকেট আজিজুর রহমানঃ

দিনাজপুরের বারের লব্ধ প্রতিষ্ঠিত আইনজীবি, সুলেখক, সম্পাদক, সংসদ সদস্য ও রাজনীতি ক্ষেত্রে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন। তিনি আওয়াজ নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা বের করেন সেই সময় যখন ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনের সূত্র ধরে বাঙ্গালীর জাতিস্বত্বা সৃষ্টিতে নবচেতনার উম্মেষ, রাজনীতিতে বিরোধী দলের উদ্ভব, স্বাধিকার ও সাধারণ নির্বাচনের দাবী, পাকিস্তানী স্বৈরশাসনে জর্জরিত জনজীবন। বঙ্গবন্ধুর উদাত্ত্ব আহবানে স্বাধীনতায় উত্তরণের সুস্পষ্ট পূর্বাভাস-এমনই এক অস্থির অস্বস্থিকর পরিস্থিতিতে সাপ্তাহিক আওয়াজ জেলাবাসীর মনোভূমি সৃষ্টিতে অসাধারণ চেতনা জাগায়। যখন মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয় তখন যুদ্ধের সংগঠন ও সংস্থানের ব্যবস্থাপনায় প্রাণান্তকর পরিশ্রম করেন তিনি। ঐ সময় তিনি মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে অনেকগুলি জ্বালাময়ী বক্তৃতা করেন যা দেশবাসীর মনে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে অপূর্ব সাড়া জাগায়। দিনাজপুর বড় মাঠে আয়োজিত বিজয় উৎসবে (২০/১২/৭১) তার প্রদত্ত ভাষণটি ছিল অপূর্ব উন্মাদনাময়ী, আবেগময়ী ও জ্বালাময়ী। তিনি রাজনীতির চর্চা করে গেছেন রাজনীতির জন্য অন্য কোন মতলবে নয়। তিনি ভোগীর চেয়ে ত্যাগী ছিলেন বেশী। তাবৎ কাজে নিজস্ব সহায় সম্পদ উজাড় করে দিতে ছিলেন অকুণ্ঠচিত্ত। তিনি ১৯৯১ খ্রীষ্টাব্দে মৃত্যু বরণ করেন।

 

 

এ্যাডভোকেট গোলাম রহমানঃ

দিনাজপুর বারের লব্ধপ্রতিষ্ঠিত তথা ডাইসাইটে আইনজীবি গোলাম রহমান ক্ষেত্রীপাড়া মহল্লানিবাসী ছিলেন। ছাত্রজীবন থেকেই আকৃষ্ট ছিলেন বিরোধী রাজনীতির প্রতি। ২১ এর ভাষা আন্দোলনে তার সক্রিয় অবদান ছিল। পঞ্চাশের দশকে আইন পাশ করে শিক্ষকতা ছেড়ে তিনি জেলা বারে যোগদান করেন এবং আইনগত মেধা ও মুগ্ধকর আর্গুমেন্ট উপস্থাপিত করতে পারায় অল্প সময়ের মধ্যে একজন তুখোড় আইনজীবি রূপে সবিশেষ পরিচিতি লাভ করেন। তার পার্শ্ব প্রবণতা ছিল রাজনীতিতে। কিন্তু সুবিধা করতে পারেননি। না করতে পারার কারণ তিনি রাজনীতি করতেন সখের রাজনীতি করার মত-যতটা নিবিষ্ট ও গুরুত্ব হওয়ার প্রয়োজন ততটা নয়। তাই তিনি আইনজীবি রূপে যতটা সফলকাম রাজনীতিতে ততটা নন। তার রাজনৈতিক জ্ঞান, প্রজ্ঞা, বোলচাল, বিশেষ করে শ্রোতাদের হৃদয় আকৃষ্টকারী রাজনৈতিক বক্তৃতা সবই ছিল সম্বাবনাময়। একবার স্বীয় এলাকা থেকে আইন সভার নির্বাচন প্রার্থী হয়েছিলেন কিন্তু টিকতে না পারায় তখন থেকে রাজনীতির সক্রিয়তা থেকে প্রায় সরে পড়েন। সব কিছুর উপর তিনি ছিলেন একজন সফল আইন ব্যবসায়ী। তিনি ১৯৭৮ খ্রীষ্টাব্দে মৃত্যু বরণ করেন।

 

 

অধ্যাপক ইউসুফ আলীঃ

জেলার রাজনৈতিক আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় একজন বিশিষ্ট ও স্বনামধন্য রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ছিলেন অধ্যাপক ইউসুফ আলী। পাকিস্তান আমলে এম,এন,এ (৬৫), স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু সরকার, পরবর্তী খোন্দকার মোস্তাক আহমদ সরকার, জিয়াউর রহমান সরকার এবং এরশাদ সরকার পর্যায়ক্রমে ৪টি সরকারের শিক্ষা, সমাজ কল্যাণ, বস্ত্র, ত্রাণ প্রভৃতি মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীরূপে প্রায় দশবার মন্ত্রীত্বের শপথ গ্রহণ করেন। দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের পাতায় ইহা একটি বিরল দৃষ্টান্ত। যখন রাজনীতিতে তার প্রথম প্রবেশ দেশে তখন সামরিক শাসন-তা সত্বেও বিরোধীয় মঞ্চ থেকে পাকিস্তান সংসদে একজন তরুণ পার্লামেন্টেরিয়ান রূপে তার নির্ভীক ও বলিষ্ঠ কণ্ঠ সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ও পরিচালকের ভূমিকায় দায়িত্ব সঠিকভাবে পালনের জন্য তিনি প্রশংসিত হন। ওপার রাষ্ট্রে অগণিত শরনার্থীদের ত্রাণ বিভাগের পরিচালনার ভার ছিল তারই দায়িত্বে। মুক্তিযুদ্ধের সময় ওপার রাষ্ট্রে গঠিত প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের স্বাধীনতা সনদ পাঠ করে অসাধারণ খ্যাতির অধিকারী হন। ব্যক্তি জীবনে অত্যন্ত বিনয়ী, সাদাসিদে, মিষ্টভাষী, নিরংহকারী ও লোকপ্রিয়তার স্পর্শে মানুষের হৃদয় জয় করেন। এক কথায় মাটির মত মানুষ ছিলেন তিনি। জেলার শিক্ষা মন্ত্রী থাকাকালে নশিপুরে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়-এর ভিত্তি স্থাপন, বস্ত্রমন্ত্রী রূপে টেক্সটাইল মিল স্থাপন এবং এরশাদের আমলে যখন তিনি মন্ত্রী তখন তারই চেষ্টায় পূর্নরভবা নদীর উপর কাঞ্চন সেতু নির্মিত হয়। যে সেতুটির দাবী ছিল এলাকাবাসীর প্রায় ৫০ বছরের পুরাতন (মেহরাব আলী সম্পাদিত ‘ভবানীপুর পত্রিকা’, ৪৩ সালের সংখ্যা ও দিনাজপুরে সাংবাদিকতার একশ বছর গ্রন্থ-৭০ পৃঃ দ্রষ্টব্য)। বস্ত্ততঃ মানুষ মাত্রই বিতর্কের উপরে নয়, একেবারে নীচেও নয়। বিশেষ করে রাজনীতি যারাকরেন । সেই আলোকে বিশিষ্ট রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব অধ্যাপক ইউসুফ আলী পশ্চাতে বিতর্কের বাস্তবতা স্বীকার করে তার সংসদীয় জ্ঞান প্রজ্ঞা অভিজ্ঞতা ও যোগ্যতা; তদুপরি অসাধারণ মনোমুগ্ধকর বক্তৃতা প্রভৃতি গুণরাশির সুবাদে মানুষের মনে তার যে অবস্থান প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তা বিতর্কের অনেক উর্দ্ধে। তিনি ১৯৯৯ খ্রীষ্টাব্দে মৃত্যু বরণ করেন।

 

 

 

মইন উদ্দিন আহমেদ চৌধুরীঃ

একটা সময় ছিল যখন একজন মানুষ হিসেবে নামটি ছিল জেলাবাসী দল, মত, গোষ্ঠী, শ্রেণী নির্বিশেষে সবার মুখে মুখে। তার অবর্তমানে সেই প্রিয় নামটি এখনও সবার মুখে মুখে প্রবাদের মতোই বর্তমান, তিনি ঘুঘুডাঙ্গার সম্ভ্রান্ত চৌধুরী বংশীয় কৃতি সন্তান মইন উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী। চৌধূরী বংশের প্রথম উচ্চ শিক্ষিত (আলীগড়ের এমএ) মইনউদ্দিন চৌধুরী রাজনৈতিক ক্ষেত্রে জেলা মুসলিম লীগের সেক্রেটারী (১৯৪৬), অনারারী ম্যাজিস্ট্রেট (৪৭), প্রভিন্সিয়াল কাউন্সিলের উপদেষ্টা (৬১), প্রাদেশিক আইন পরিষদের সদস্য (৬২) এবং ১৯৭০ সালে পার্লামেন্টারী সেক্রেটারী পদে অধিষ্টিত ছিলেন। মুসলিম লীগ পন্থী হয়েও তিনি ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে। ফলে স্বাধীনোত্তর যুগে রাজশাহী উন্নয়ন বোর্ডের স্থানীয় সদস্য পদ লাভ করেন (৭৭)। জেলার অন্যান্য উন্নয়নের ক্ষেত্রে প্রায় প্রত্যেকটি পদক্ষেপের সঙ্গে জড়িত ছিলেন তিনি। তন্মধ্যে নাজিমুদ্দিন হলের সেক্রেটারী, যাদুঘরের সদস্য, ঘুঘুডাঙ্গা হাইস্কুলের সভাপতি, আঞ্জুমান মফিদুল ইসলামের সদস্য, জেলা ক্রীড়া সংগঠনের সদস্য, ষ্টেশন মোড়ের (পুরাতন) মসজিদের তত্ত্বাবধায়ক, সেরাজউদ্দিন চৌধুরী ট্রাস্ট প্রভৃতি সংস্থা/সংগঠনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন তিনি। ব্যক্তিগত জীবনে অত্যন্ত সৎ, সরল, সদালাপী এবং নিরহংকার প্রকৃতির মানুষ মইনউদ্দীন চৌধুরীর সর্বোচ্চ কৃতিত্ব ছিল তিনি সর্বশ্রেণীর মানুষের মন জয় করতে পেরেছিলেন যা কিনা কবির কথায় ‘দুর্লভ উপার্জন’। তিনি ১৯৯৯ খ্রীষ্টাব্দে মৃত্যু বরণ করেন।

 

 

পন্ডিত গোপাল চন্দ্র ভট্টাচার্যঃ

প্রধানতঃ পন্ডিত স্যার বলে সুপরিচিত গোপালচন্দ্র জেলা স্কুলের ছাত্রপ্রিয় শিক্ষক ছিলেন। সেই সঙ্গে অধিষ্ঠিত ছিলেন তদীয় বাসভবন সংলগ্ন ধর্মসভা সংস্কৃত মহাবিদ্যালয়ের অবৈতনিক অধ্যক্ষের পদে। তিনি শুধু ছাত্রপড়ানো শিক্ষই ছিলেন না, সেই সঙ্গে ছাত্রপাঠ্য শিশু সাহিত্যেরও সুলেখক ছিলেন। শিশু সাহিত্যের মনোরঞ্জক অনেক গ্রন্থের লেখক রূপে তার প্রচুর খ্যাতি ছিল। মৎস্য কন্যা, গুজরাতি হাতী প্রভৃতি তার প্রকাশিত গ্রন্থ এবং প্রকাশিত হয়নি এমন পান্ডুলিপির সংখ্যা অনেক। তার শেষের দিকে লেখা একটি সামাজিক নাটক পাঁচ বিবি যা গন্থাকারে প্রকাশিত হয়নি, তবে নবরূপী কর্তৃক নাট্য সমিতি হলে মঞ্চস্থ হয় এবং দর্শক প্রশংসা কুড়াতে সক্ষম হয়। শিশু সাহিত্যিক হওয়ার চাইতে শিশুর শিক্ষক রূপেই তার জীবনের সার্থকতা বেশী কারণ তাকে দেখলেই শিশু ছাত্ররা সম্মানে ও ভক্তিভরে নমস্কার জানাতে ছুটে আসতো, ভয়ে বা অনাগ্রহে দূরে সরে যেতো না। বলাবাহুল্য একজন শিক্ষকের কি পরিমাণ ছাত্রপ্রিয়তা অর্জন করতে পারা সম্ভব হলে এমন সৌভাগ্য সম্পর্ক গড়ে উঠা সম্ভব হয়? বর্তমান ছাত্র শিক্ষকের সম্পর্কের অবক্ষয়মান দর্পণে ব্যাপারটা প্রতিবিম্বিত না হয়ে যায় না। তিনি ১৯৯৬ খ্রীষ্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন।

 

 

সতীশ চন্দ্র সরকারঃ

খ্যাতনামা সঙ্গীত শিল্পী রূপে দিনাজপুরে যে নামগুলি সর্বজন পরিচিত, শিল্পী সতীশ সরকারের নামটি অন্যতম। মনু সরকার নামে পরিচিত এই শিল্পীর পেশাগত জীবনের ব্যস্ততার মধ্যে ছিল সঙ্গীত চর্চার অনলস লিপ্ততা ও নিমগ্নতা। যা তার জন্য সফলতা বয়ে আনে, বিশেষ করে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতে ও সঙ্গীত শিক্ষার প্রয়োগ শিল্পে। সঙ্গীতানুরাগী ছাত্রছাত্রীর কাছে তিনি খুবই সমাদৃত ছিলেন। ৪৭ এর দেশ বিভাগের ফলে শহরের নামকরা সঙ্গীত শিল্পীগণ উদ্বাস্ত হওয়ায় ক্ষেত্রটি একেবারে শূন্যতায় পরিণত হয়। শিল্পচর্চার সেই বিশেষ যুগসন্ধিক্ষণে শূন্যতা পূর্ণ করতে যে কজন সঙ্গীত শিল্পী এগিয়ে এসেছিলেন তাদের মধ্যে মনু সরকারের নামটি উল্লেখের সঙ্গে ওস্তাদ খেতু বাবু, ওস্তাদ কসির, সি, জি রববানী, মজিবর রহমান, মাহতাবউদ্দিন আহমদ, বুদ্ধদেব সরখেল ও অনেক হারিয়ে যাওয়া নামগুলি উল্লেখ্য। কিন্তু সৌভাগ্য অনেক সময় অনেকের জন্য দুর্ভাগ্যেরও কারণ হয়। প্রমাণ রেখে গেছেন খ্যাতনামা শিল্পী সতীশ সরকার। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ শিল্পী হওয়ার অপরাধে ঘাতক বিহারীগণ দ্বারা নিজ বাসভবনে নিষ্ঠুর ভাবে নিহত হন। তিনি ১৯৭১ খ্রীষ্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন।

 

 

শহীদ সাংবাদিক গোলাম মোস্তফাঃ

দিনাজপুর এসএন কলেজের বিপ্লবী ছাত্রনেতা ও সংগঠক-সাহিত্য, নাট্যাভিনয়, খেলাধূলা প্রভৃতি বিবিধ যুব উন্নয়নমূলক কাজের নির্বিষ্ট নিবেদিত কর্মী ছিলেন আঃ নঃ মঃ গোলাম মোস্তফা। সাংবাদিকতা ক্ষেত্রেই বেশী প্রবণতা ও দক্ষতা ছিল ছাত্রাবস্থা থেকেই। তারই প্রধান উদ্যোগে শহর থেকে পাক্ষিক কাঞ্চন প্রকাশিত হয় (১৯৬৩) সাংবাদিকতা ছাড়াও সাধারণ লেখালেখিতেও ছিল তার ক্ষুরধার হাত। তার মধ্যে যে প্রতিশ্রুতিশীল প্রতিভার সম্ভাবনা ছিল তার সম্যক বিকাশের ক্ষেত্রের উপযোগিতা দিনাজপুরে ছিল না। ফলে সাংবাদিকতার চাকুরী নিয়ে ঢাকায় যান এবং বিকাশের বিশাল ক্ষেত্র খুঁজে পান। এর মধ্যে শুরু হয় ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ, রাজাকারগণ কর্তৃক বুদ্ধিজীবি নিধনযজ্ঞ। এই প্রতিশ্রুতিশীল তরুণও ঘাতকদের শিকার হন, অস্ত্রাঘাতে নিহন হন নিষ্ঠুর ভাবে। তখন তিনি ঢাকায় দৈনিক আজাদ পত্রিকায় সাংবাদিকতায় চাকুরীরত। মুক্তিযুদ্ধে শহীদ বুদ্ধিজীবিগণের একজন ছিলেন দিনাজপুরের এই প্রিয় সন্তান। তিনি ১৯৭১ খ্রীষ্টাব্দে মৃত্যু বরণ করেন।

 

 

কবি আঃ কাঃ শঃ নূর মোহাম্মদঃ

১৯৪৭ এর দেশবিভাগের পর প্রাথমিক যুগের বাংলাদেশের শ্রেষ্ট কবি নূর মোহাম্মদ। তিনি মূলতঃ কবি হয়েও গান, উপন্যাস, নাটক, জীবনী, প্রবন্ধ প্রভৃতি রচনাতে সিদ্ধ হস্ত ছিলেন। গৌড়বঙ্গ সাহিত্য পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা, নওরোজ সাহিত্য মজলিশের প্রতিষ্ঠাতাদের অন্যতম এবং অনেক কাব্য, উপন্যাস, ইতিহাস, জীবনী গ্রন্থেও লেখক ছিলেন। তিনি মৃত্যুবরণ করেন দিনাজপুরেই। তার জন্ম ১৯২৩ খ্রীষ্টাব্দে এবং মৃত্যু ১৯৮৪ খৃষ্টাব্দে।

 

 

 

শহীদ মেজর মাহবুব (বীরউত্তম)

৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের সময় খাঁন সেনার সঙ্গে মুখোমুখি যুদ্ধ করেছেন, প্রত্যক্ষ যুদ্ধে শহীদ হয়েছেন এমন ভাগ্যবানের সংখ্যা কম নয়। তবে মেজর/কর্ণেল পদস্থ মুক্তিযোদ্ধা সেনা নায়ক শহীদ হয়েছেন একজনই তিনি শহীদ মেজর মাহবুব (বীর উত্তম)। বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ অধ্যক্ষ তসির উদ্দিন আহমদের পুত্র (কনিষ্ঠ) মেজর মাহবুব অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র ছিলেন এবং সৈনিক হবার নেশা ছিল বাল্যকাল থেকে। সৈনিক হয়েছিলেন এবং মৃত্যুবরণ করেছিলেন একজন শহীদ সৈনিক রূপে। আসাম সীমান্তে তিনি শহীদ হন এবং মরণোত্তর বীর উত্তম উপাধি লাভ করেন। তদুপরি পার্বতীপুর খোলাহাটি স্থানে নবনির্মিত সেনানিবাসটি শহীদ মেজর মাহবুবের অমর স্মৃতি-স্মারকে নিদর্শন রূপে নামাংকিত করা হয়। তিনি ১৯৭১ খ্রীষ্টাব্দে মৃত্যু বরণ করেন।

 

 

কমরেড ফরহাদঃ

কমরেড ফরহাদ ছিলেন স্বনামে স্বনামধন্য। ফরহাদ দিনাজপুরবাসীর অহংকার। মেধাবী ও বিপ্লবী ছিলেন ছাত্রজীবন থেকেই। কর্মজীবনের শুরুতেই আকৃষ্ট হন কমিউনিস্ট আন্দোলনের প্রতি। এই আন্দোলনই ছিল তার ধ্যান ধারণা ও জীবন সাধনা। নীতিনিষ্ঠা ও আন্দোলনের প্রতি বিশ্বস্ততাই তাকে দৃষ্টান্ত স্থলে পরিণত করে। বাংলাদেশের কমিউনিষ্ট ভূবনের প্রবাদ পুরুষ মনি সিং এর স্নেহধন্য উত্তরসুরী ফরহাদ। অদম্য কর্মনিষ্ঠা, সততা, বিশ্বস্ততা ও সাংগঠনিক তৎপরতায় অত্যল্পকালের মধ্যে উক্ত আন্দোলনের দৃষ্টান্ত স্থলে পরিণত হন। যখন মনি সিং এর জীবনাবসান হয় পার্টি প্রধানের দায়িত্ব তারই ভাগ্যে ভেসে আসে। তিনি পার্টির সভাপতির পদ লাভ করেন। তার পিতা সাদাকতুল বারী স্থানীয় জেলা স্কুলের অতি ছাত্রপ্রিয় শিক্ষক ছিলেন। তার জীবন ধারায় পৈত্রিক আদশের উত্তরাধিকারীত্ব ছিল নিঃসন্দেহে। পিতার মতই ছিল সাদাসিদে জীবন। যখন তিনি কমিউনিষ্ট রাজনীতির কর্ণধার, তখন পুঁজিবাদী ক্ষমতাসীন পাক সরকার যমের মত শত্রু ছিল ঐ প্রগতিবাদী আন্দোলনটির প্রতি। ফলে সঠিক পথে আন্দোলন চালাতে গিয়ে তাকে জীবনের অধিকাংশ দিন কাটাতে হয়েছিল কারাগারে, নয়ত আন্ডার গ্রাউন্ডে। তিনি ব্যর্থ হননি, উপরন্ত লাভ করেন আন্তর্জাতিক খ্যাতি। আমন্ত্রিত ভ্রমণ করেন সোভিয়েত রাশিয়া ও আরো বহু দেশ। ভাষা সৈনিক, সাংবাদিক, রাজনীতিক ফরহাদ ছিলেন অতি ক্ষণজন্মা পুরুষ। তিনি ১৯৮৭ খ্রীষ্টাব্দে মৃত্যু বরণ করেন।

 

 

খাঁন বাহাদুর একিনউদ্দিন আহমদঃ

জেলার মুসলিম নেতৃত্বের জনক ও বারের প্রথম ইংরেজীনবীশ মুসলমান আইনজীবি (১৮৯২)। জেলাবাসী মুসলমানদের প্রথম রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান দিনাজপুর মুসলমান সভার (১৯০৪) প্রতিষ্ঠাতা ও মুসলিম হোষ্টেল (১৯১০) নামক মুসলমান ছাত্রাবাসের স্থাপয়িতা, এমনকি জেলার রাজনৈতিক আন্দোলনের ধারায় প্রথম এমএলএ হিসেবে জেলাবাসী মুসলিম জাগরণের পথিকৃৎ ছিলেন। ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ রাজনীতির পটভূমিতে তিনি প্রচুর অবদান রাখেন মুসলমানদের স্বার্থ রক্ষায়। কৃতিত্বপূর্ণ কাজের পুরস্কার স্বরূপ খাঁন বাহাদুর উপাধি লাভ করেন। তিনি ১৯৩৩ খ্রীষ্টাব্দে মৃত্যু বরণ করেন।

 

 

শামসুজ্জোহা মানিকঃ

দিনাজপুর শহরের একটি ক্রীড়াবিদ পরিবার থেকে আসা মানিক ভাই একজন কৃতি ফুটবলার ও ফুটবল খেলার দক্ষ সংগঠক ছিলেন। বিভাগপূর্ব যুগেই তার ফুটবল খেলায় হাতে ঘড়ি প্রথমে টাউন ক্লাবে। জেলার বাইরে প্রথম প্রীতিম্যাচ খেলেন রংপুরের টাউনক্লাব মাঠে। এভাবেই তার খেলান্নতির ধারা এগিয়ে চলে। ৪৭ এর দেশ বিভাগ হয়। হিন্দু খেলোয়াড়গণ যারা ছিলেন বরাবর টাউন ক্লাবের খেলার ও ব্যবস্থাপনার মাঠ দখল করে তারা হঠাৎ ৪৭ সালে দেশ ত্যাগ করায় শহরের ক্রীড়াঙ্গন ফাঁকা হয়ে পড়ে। অচলাবস্থা চলে বেশ কবছর। নরনারায়ন শীল্ড প্রতিযোগিতাও লুপ্ত হয়। টাউনক্লাবের পূর্ণগঠন ও হারিয়ে যাওয়া ফুটবল খেলাকে ফিরিয়ে আনতে অনিশ্চিত পটভূমিতে যে সামান্য ক’জন খেলোয়াড়কে এগিয়ে আসতে দেখা যায় এবং যাদের প্রাণান্তকর পরিশ্রম ও দক্ষ ব্যবস্থায় ফুটবলের ঐতিহ্যের ধারা আবার শুরু হয় তাদের মধ্যে মানিক ভাই, বাবু ভাই, সামাদ, হাসান, হীরু, ইফসুফ, খতিব প্রমুখ নামগুলি উল্লেখযোগ্য। নরনারায়ন শীল্ড প্রতিযোগিতার স্থলে প্রবর্তন করা হয় শেরে বাংলা কাপ প্রতিযোগিতা। ভেঙ্গে পড়া ক্রীড়াঙ্গন আবার জেগে উঠে। অগ্রগামিতার ভূমিকায় মানিক ভাই ছিলেন অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু। তিনি ১৯৯৯ খ্রীষ্টাব্দে মৃত্যু বরণ করেন।